মো. বশিরুল ইসলাম
প্রকাশ : ১০ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১০ জুলাই ২০২৫, ০৭:৩৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দেশি মাছ রক্ষায় প্রজননকালীন কঠোরতা প্রয়োজন

দেশি মাছ রক্ষায় প্রজননকালীন কঠোরতা প্রয়োজন

গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে আমার জন্ম। গ্রামে বেড়ে ওঠা। ছোটবেলায় দেখেছি, বর্ষা মৌসুমে বিভিন্ন ধরনের দেশি মাছে ভরে যেত খাল-বিল ও নদী-নালা। আমরা ধানি জমিতে কইয়া জাল, বড়শি ও আন্তা পেতে মাছ ধরতাম। খাল-বিলে তখন এত মাছ ছিল যে, পানিতে নেমে খালি হাতেও মাছ ধরতে পারতাম। দেশি প্রজাতির কই, শিং, মাগুর, শোল, টাকি, বোয়াল, বৈচা, টেংরা, চিংড়ি, পুঁটি, বাইন, মলাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পেতাম। গ্রামের মানুষ বেড়াজাল, ধর্মজাল, ঠেলাজাল দিয়ে প্রচুর মাছ ধরত। এ সময়ে মাছ সংগ্রহ করে তা শুকিয়ে শুঁটকি করে রাখা হতো। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন আর তেমন দেখতে পাওয়া যায় না।

তবে, মাছের উৎপাদনের দিক দিয়ে কিন্তু বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে উন্নতি করেছে। গত দুই দশকে কৃত্রিম প্রজনন ও চাষের মাধ্যমে মাছের সরবরাহ ও চাহিদা অনেকাংশে বাড়ানো হয়েছে। বিলুপ্তপ্রায় কিছু ছোট মাছও আজকাল চাষ হচ্ছে। মৎস্যবিজ্ঞানীরা এ জায়গাটায় বড় ভূমিকা রেখে চলেছেন। ফলে, সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় দাবি করা হচ্ছে, বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। জলাশয় কমে যাওয়াসহ নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বর্তমানে দেশে মাছের উৎপাদন ৪৯.১৫ লাখ মেট্রিক টন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএওর ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার ২০২৪’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, মিঠাপানির মাছ আহরণে বাংলাদেশ চীনকে টপকে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। এ ছাড়া বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে পঞ্চম স্থানের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে।

এই প্রতিবেদন অবশ্যই আশাব্যঞ্জক; কিন্তু বাস্তবচিত্র ভিন্নতর। গ্রামগঞ্জে এখন আর দেশি প্রজাতির মাছ খুব একটা দেখা যায় না। বাজারে ঢুকলেই চোখে পড়ে নানা প্রজাতির চাষের মাছ। বাজারে চাষের রুই, কাতলা, কই, শিং, তেলাপিয়া, পাঙাশ এবং কার্প প্রজাতির মাছই বেশি। দেশীয় মাছ বিক্রেতা কম। তবে তারা যে দাম হাঁকছেন, তা নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এখন চাহিদা সত্ত্বেও ক্রেতারা দেশি প্রজাতির মাছের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মুক্ত জলাশয়ের মাছ কেনার কথা সাধারণ মানুষ ভাবতেও পাচ্ছে না।

নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদনদী, খাল-বিল-নালা, পুকুর ডোবা, হাওর-বাঁওড়, পানিবদ্ধ বিলগুলো দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রধানতম উৎস। এসব উৎস ধ্বংস বিশেষ করে, শহর-গ্রাম সবখানেই নদী-খালসহ সব ধরনের জলাশয়ের সংখ্যা দিন দিন কমছে। এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে এ মাছগুলো বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে? আসলে এ মাছগুলো এমনি এমনি বিলুপ্ত হচ্ছে না; বরং বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। আজ আমরা অধিক ফলনের আশায় জমিতে অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করছি। এসব কীটনাশক বৃষ্টির পানির মাধ্যমে নদনদী, খাল-বিল-নালা, ডোবা, হাওর-বাঁওড় গিয়ে পড়ে। ফলে, মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়া খাল-বিলে বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরা এবং বিষাক্ত বর্জ্য ফেলায় দেশি মাছ এখন হুমকিতে।

দেশি মাছ কমার পেছনে অনেক কারণের মধ্যে আর একটি হলো বিভিন্ন ধরনের নিষিদ্ধ জালের অবাধ ব্যবহার। বিশেষ করে চায়না দুয়ারি, কারেন্ট জাল, সম্প্রতি বৈদ্যুতিক শক মেশিনসহ আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহার। চায়না দুয়ারি মূলত মাছ ধরার ফাঁদ। এটি চায়না জাল, ম্যাজিক জাল নামেও পরিচিত। এর ব্যবহার ক্রমে বাড়ছে। এ জালের বুননে একটি গিঁঠ থেকে আরেকটি গিঁঠের দূরত্ব খুব কম। এতে মাছ একবার ঢুকলে আর বের হতে পারে না। মাছ শিকারিরা এই জাল ব্যবহার করে খুশি হলেও মূলত এ জাল কারেন্ট জালের চেয়েও ক্ষতিকর। এই জালে দেশি মাছ, কাঁকড়া, এমনকি মাছের পোনা, সাপ-ব্যাঙসহ সব জলজ প্রাণী আটকা পড়ে যায়। ক্ষতিকারক এসব উপকরণে মাছ শিকার করায় বংশ বিস্তার কমে যাওয়ার পাশাপাশি হুমকির মুখে পড়ছে জীববৈচিত্র্য।

২০০২ সালে সরকারের জারি করা মৎস্য সুরক্ষা ও সংরক্ষণ আইনের ৪(১) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি কারেন্ট জালের উৎপাদন, বুনন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, সংরক্ষণ, বহন, মালিক হতে বা ব্যবহার করতে পারবেন না। আইন ভঙ্গ করলে জেল-জরিমানার বিধানও রাখা হয়েছে। বাস্তবে এই আইন যে মানা হচ্ছে না, তা নদী-নালা, খাল-বিলের অবাধে মাছ ধরা দৃশ্য দেখলে দেখা যাবে। কারেন্ট জাল কিংবা চায়না দুয়ারি জাল দিয়ে খাল-বিলের ছোট ছোট মাছ থেকে শুরু করে দেশি প্রজাতির ডিমওয়ালা মাছ বেশি ধরা হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে; অন্যদিকে মাছের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারেন্ট জাল আটক এবং সংশ্লিষ্ট জেলেদের মোটা অঙ্কের অর্থ জরিমানার খবর আমরা শুনতে পাই। কিন্তু সামগ্রিকভাবে যে খামখেয়ালি রয়েছে, তা স্পষ্ট। কিন্তু এরকম তো চলতে পারে না। দেশের মৎস্যসম্পদ রক্ষা করতে হলে অবশ্যই এ জালের ব্যবহার, উৎপাদন ও বিক্রির বন্ধ করতে হবে। শুধু আইন বা প্রকল্প করে নয়, দেশীয় প্রজাতির মাছ রক্ষায় প্রজনন মৌসুমের দুই মাস না হলেও অন্তত এক মাস দেশি মাছ শিকার বন্ধ রাখতে হবে। যেমনভাবে ইলিশ সংরক্ষণে বাংলাদেশের সরকার ‘মৎস্য সংরক্ষণ আইন’ প্রয়োগ করেছে। এই আইন অনুসারে প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরা, বিক্রি, সংরক্ষণ ও পরিবহন নিষিদ্ধ করা হয়, যাতে ইলিশের প্রাকৃতিক বংশবৃদ্ধি নিশ্চিত করা যায়। এই পদক্ষেপগুলো ইলিশের প্রাকৃতিক উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করে এবং ভবিষ্যতে ইলিশের মজুত বৃদ্ধি ও এর মাধ্যমে জেলেদের অর্থনৈতিক অবস্থাও সুদৃঢ় করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। ইলিশের মতো দেশি মাছের প্রজনন সময় ধরা, ক্রয়-বিক্রয় কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলে দেশি মাছে ভরে উঠবে পুরো দেশ, যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করা সম্ভব হবে। প্রয়োজনে জেলেদের প্রণোদনা দিয়ে হলেও তার বাস্তবায়ন করতে হবে। এরই মধ্যে দেশীয় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলে প্রথমবারের মতো এক মাসের জন্য মাছ ধরা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

দেশি মাছের প্রজনন মৌসুম সাধারণত বর্ষাকাল। বিশেষ করে জ্যৈষ্ঠ মাসের মধ্য থেকে শ্রাবণ মাস। জ্যৈষ্ঠ মাসের মধ্যকালে প্রথম বৃষ্টির পর থেকেই এসব স্বাদুপানির মাছ ডিম ছাড়া শুরু করে, যা চলে শ্রাবণ মাসের মধ্য পর্যন্ত। বৃষ্টির পরপরই যখন বিভিন্ন জলাশয় পানিতে ভরে যায়, তখন নদনদী, খাল-বিল-নালা, হাওর-বাঁওড়, ধানক্ষেতসহ জলাবদ্ধ বিলগুলো জলাজমির সঙ্গে মিশে যায় এবং তখন মুক্ত জলাশয় থেকে ছড়িয়ে যায় মাগুর, শিং, কই, টাকি, শৈল, টেংরা, পুঁটি, মলা, বাইন, বোয়াল প্রভৃতি দেশি মাছ। আর এসব মাছ শিকারে মেতে ওঠে পেশাদার জেলেসহ মৌসুমি জেলেরা। যার মধ্যে অধিকাংশ থাকে ডিম ছাড়ার পর্যায়ের ‘মা মাছ’। যদিও পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ শিকার, ক্রয়-বিক্রয় আইনত অপরাধ; কিন্তু তা আইনের খাতায় ফাইল বন্দিই থাকে। বাস্তবে প্রয়োগ হয় না। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে হাওরাঞ্চলসহ দেশের খাল-বিল, নদনদীতে মাছের আকাল পড়বে। এমন একটি সময় আসবে যখন দেশি মাছ আর পাওয়াই যাবে না।

দেশি প্রজাতির মাছ রক্ষায় আর একটি করণীয় হচ্ছে অভয়াশ্রম তৈরি করা। প্রতি শুষ্ক মৌসুমে উন্মুক্ত জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায় মাছের আশ্রয়স্থল দিন দিন কমে যাচ্ছে। হাওর ও বিল সেচে অবাধে মাছ শিকারের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির মাছ। মৎস্য বিভাগ দেশি জাতের মাছ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জেলায় অভয়াশ্রম গড়ে তুলেছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, অভয়াশ্রমে নিরাপদে দেশীয় মাছের প্রজনন ঘটানো, মাছের বংশ বৃদ্ধি ঘটানো; কিন্তু একশ্রেণির মানুষের লোভের কারণে এ লক্ষ্য অর্জন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিকারিদের দমনে প্রযুক্তিগত নজরদারি বাড়ানো যেতে পারে। ড্রোন বা নৌপুলিশ নিয়োজিত করার মতো আধুনিক পদ্ধতির প্রয়োগ কার্যকর হতে পারে।

তাই বিলুপ্তপ্রায় দেশি মাছগুলো রক্ষা করতে খাল-বিল, পুকুর, ডোবাগুলো সুগভীর খননের মাধ্যমে মিঠাপানি প্রবাহের ব্যবস্থা করতে হবে। চায়না দুয়ারি ও কারেন্ট জাল উৎপাদন এবং বিপণন প্রক্রিয়ায় জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে হবে এবং মৎস্য আইনের ধারাগুলো নিশ্চিতভাবে অনুসরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে মৎস্য কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে, যা তাদের কাজের ক্ষমতাকে আরও বৃদ্ধি করবে এবং মৎস্য সম্পদ সুরক্ষায় আরও বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে সহায়ক হবে। কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কৃষকরা সার ব্যবহারে কীভাবে জৈবিক পরিবর্তন আনবে, তা আরও গবেষণার আওতায় আনা প্রয়োজন। মা মাছের প্রজননকালীন তাদের রক্ষা ও ডিম ছাড়ার উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতেই হবে। সর্বোপরি, দেশীয় প্রজাতির মাছ রক্ষায় সর্বস্তরের জনসাধারণকে সচেতন করে তুলতে হবে।

লেখক: কৃষিবিদ, উপপরিচালক

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নাক ডাকার সমস্যায় ভুগছেন? জেনে নিন সমাধান

বন্যার পানিতে মাছ ধরতে গিয়ে একজনের মৃত্যু

বিয়ের আগেই অন্তঃসত্ত্বা, যা বললেন নেহা

১২ শিক্ষকের সেই স্কুলে এবারও সবাই ফেল

দ্বিতীয় দিনের বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আলোচনা শেষ

এসএসসিতে আমিরাতের ২ প্রতিষ্ঠানে পাসের হার ৭২ শতাংশ

এক দেশে ৩৫%, অন্যদের ২০% শুল্কের ইঙ্গিত ট্রাম্পের

এসএসসির ফল পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন শুরু, যেভাবে করবেন

গাজায় বিস্ফোরণে ইসরায়েলি সেনা নিহত, উত্তেজনা চরমে

প্রথম প্রেম ভুলতে পারেননি আনুশকা

১০

রাবিপ্রবিতে প্রথমবার ছাত্রদলের কমিটি

১১

শেষ ওভারের নাটকীয়তায় রংপুরের জয়

১২

প্রতিদিন ১৫ মিনিট হাঁটলেই ৭ পরিবর্তন আসবে আপনার

১৩

কক্সবাজারে এসএসসিতে ফেল করায় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

১৪

নদীতে সেতু ভেঙে পড়া নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীর রোমহর্ষক বর্ণনা

১৫

যমজ দুই ভাইয়ের আশ্চর্যজনক ফলাফল

১৬

ছবিতে প্রথমে কী দেখতে পাচ্ছেন, উত্তরই বলে দেবে আপনি আসলে কেমন

১৭

৮ শিক্ষকের স্কুলে ৯ পরীক্ষার্থী, অথচ সবাই ফেল

১৮

চলন্ত বাইক থেকে ফেলা হলো ছাত্রলীগ নেতাকে, এরপর যা ঘটল

১৯

ইরান ভ্রমণে না যেতে যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বান

২০
X