মুফতি আরিফ খান সাদ
প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:৫২ এএম
আপডেট : ২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:২৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

এসেছে শীত, কাটুক আমলে

এসেছে শীত, কাটুক আমলে

দেশে বইতে শুরু করেছে শীতের হিমপ্রবাহ। অনেক জায়গায় জেঁকে বসেছে তীব্র শীত। কুয়াশাভেজা হিমপ্রবাহ যেন স্থবির করে ফেলছে সবকিছু। অনেক জায়গায় দেখা মিলছে না সূর্যের। ঘন কুয়াশায় দুর্ঘটনারও শিকার হয়েছেন কাজের সন্ধানে ছুটে চলা মানুষ। এরই মধ্যে কাঁপছে দেশের উত্তরের প্রত্যন্ত অঞ্চল। শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে লোকজন শুকনো খড়, কাঠ, ঘাস ও শুকনো ময়লা আবর্জনার স্তূপে আগুন জ্বালিয়ে শরীরে তাপ পোহাচ্ছেন। শীত টের পেতে শুরু করেছে রাজধানীবাসীও। শহরাঞ্চলে উষ্ণ কাপড়ের সমাহার থাকলেও কনকনে শীতে শীতবস্ত্রহীন অসহায় লোকজন, ফুটপাতে রাতযাপন করা লোকজন এবং পথশিশুরা তরতর করে কাঁপতে শুরু করে। হাত-পা বরফের মতো ঠান্ডা ও শীতল হয়ে যায়। এমন সময় মানবিক দায়বোধ থেকে চলে আসে কিছু দায়িত্বের প্রসঙ্গ। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো ধনীদের কর্তব্য। এটা যেমন মানবিক বিষয়, তেমনি ধর্মীয় বিষয়। ইসলামে শীতকালেও রয়েছে হুকুকুল্লাহ ও হুকুকুল ইবাদ তথা বিশেষ কিছু ইবাদত এবং সামাজিক-মানবিক দায়িত্ব। এসব বিষয় পালন করলে মিলবে অফুরন্ত সওয়াব।

প্রকৃতিতে ঋতুর পালাবদল মহান আল্লাহর হুকুমেই ঘটে। তিনি এতে রেখেছেন মানুষের জন্য প্রভূত কল্যাণ। শীতের এ প্রবাহও আল্লাহর হুকুমে হয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘জাহান্নাম আল্লাহর কাছে অভিযোগ করে বলে, আমার এক অংশ অন্য অংশকে খেয়ে ফেলেছে। তখন আল্লাহ তাকে দুবার শ্বাস ফেলার অবকাশ দেন। শীতে একটি, গরমে একটি। এর ফলেই তোমরা প্রচণ্ড গরম ও তীব্র ঠান্ডা অনুভব করো।’ (বুখারি : ৪৩৭; মুসলিম : ৬১৭)। তাই শীতের পরিবেশেও একজন মুমিনের কিছু নির্দেশনা রয়েছে। পবিত্র কোরআনেও শীতের আলোচনা এসেছে। সুরা কুরাইশে বলা হয়েছে, ‘কুরাইশ সম্প্রদায় যেহেতু অভ্যস্ত; যেহেতু তারা শীত ও গ্রীষ্মকালের ভ্রমণে অভ্যস্ত।’ (সুরা কুরাইশ : ১-২)। মক্কার কুরাইশ সম্প্রদায় শীতকালে ইয়েমেনের অ্যাডেন বন্দরে ও গ্রীষ্মকালে ফিলিস্তিনের গাজায় ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী বাণিজ্যনগরীতে ভ্রমণ করত।

বসন্তকালে যেভাবে গাছগাছালি ও প্রকৃতি পত্রপল্লবে সমৃদ্ধ থাকে, পশুপাখি যত ইচ্ছা খেয়ে তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারে, ঠিক তেমনি মুমিন শীতকালের দীর্ঘ রাতকে ইবাদতে কাটিয়ে এবং দিনকে রোজায় কাটিয়ে লাভ করতে পারে প্রভূত আত্মিক উন্নতি। শীতকালকে ‘ইবাদতের বসন্তকাল’ বলা হয়। আবু সাইদ খুদরি (রা.) নবীজি (সা.) থেকে বর্ণনা করে বলেন, ‘শীতকাল মুমিনের বসন্ত।’ (মুসনাদে আহমদ : ১১৬৫৬)। অন্য হাদিসে এসেছে, ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, ‘ইবাদতকারীদের জন্য শীতকাল হলো গনিমতস্বরূপ।’ (হিলইয়াতুল আউলিয়া : ১/৫১)। অর্থাৎ শীত এমন গনিমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ), যা কোনো রক্তপাত বা চেষ্টা মেহনত কিংবা কষ্ট ছাড়াই অর্জন হয়েছে। সবাই কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই এ গনিমত স্বতঃস্ফূর্তভাবে লাভ করে। কোনো প্রচেষ্টা বা পরিশ্রম ব্যতিরেকে তা ভোগ করে। সওয়াব বা পুণ্য অর্জনের বিচারে শীতকালকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দিতে হয়। শীতের রাতে আমলের বিশেষ মর্যাদার কথা বর্ণিত হয়েছে হাদিসে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি কি শীতকালে গনিমতের কথা জানাব না? তা হচ্ছে—শীতকালে দিনে রোজা রাখা এবং রাতে নামাজ আদায় করা।’ (তিরমিজি : ৭৯৫)। হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলতেন, ‘শীতকালকে স্বাগতম। কেননা তা বরকত বয়ে আনে। শীতের রাত দীর্ঘ হয়, যা কিয়ামুল লাইলের (রাতের নামাজ) সহায়ক এবং দিন ছোট হওয়ায় রোজা রাখা সহজ।’ (শুয়াবুল ইমান, বাইহাকি : ৩৯৪০)

শীতকাল আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের ইবাদতের এক বিশেষ মৌসুম। সালফে সালেহিন তথা পূর্ববর্তী সৎকর্মশীল ব্যক্তিরা শীতকালকে গনিমত হিসেবে গ্রহণ করতেন। শীতকাল এলে হজরত ইয়াহইয়া ইবনে মুয়াজ (রহ.) বলতেন, শীতের রাত দীর্ঘ। ঘুমিয়ে তাকে খাটো করো না এবং ইসলাম পবিত্র-পরিচ্ছন্ন, গুনাহর দ্বারা তাকে কলুষিত করো না। বিশিষ্ট সাহাবি হজরত মুয়াজ (রা.) মৃত্যুকালে কেঁদে কেঁদে বলেন, গ্রীষ্মকালের দুপুরের শীতল পানি আর শীতকালের রাতের নামাজের জন্য আমি কাঁদছি। অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে তিনি রোজা রাখতেন এবং শীতকালে রাত জেগে নামাজ আদায় করতেন। ইমাম মালেক (রহ.) উল্লেখ করেন, সাফওয়ান ইবনে সুলাইম (রহ.) শীতকালে ঘরের ছাদে উঠে তাহাজ্জুদ পড়তেন আর গ্রীষ্মকালে ঘরের ভেতরে পড়তেন। পূর্ববর্তী অনেক বুজুর্গানে দ্বীন সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে, তারা শীতকালে গ্রীষ্মকালীন পোশাক এবং গ্রীষ্মকালে শীতকালীন পোশাক পরে রাতে তাহাজ্জুদ পড়তেন। (লাতায়িফুল মায়ারিফ : শীত অধ্যায়)

সাহাবা ও তাবেইনদের মধ্যে শীতের আগমনের ফলে ইবাদতের ব্যাপক উদ্দীপনা সৃষ্টি হতো। ইবাদতের নবোদ্যম নিয়ে শীতকে তারা স্বাগত জানাতেন এবং এটাকে অমূল্য গনিমত মনে করে লুফে নিতেন। তারা একে অন্যকে ইবাদতের প্রতি উৎসাহ দিতেন। হজরত উবাইদ ইবনে উমাইর (রা.) বলেন, ‘কোরআন তেলাওয়াতের জন্য তোমাদের রাত দীর্ঘায়িত করা হয়েছে। সুতরাং কোরআন পড়তে থাকো। রোজা রাখার জন্য তোমাদের দিনকে ছোট করা হয়েছে। সুতরাং দিনের বেলা রোজা রাখো। শীতের রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করা (সওয়াবের ক্ষেত্রে) গ্রীষ্মের দিনে রোজা রাখার সমান।’ (লাতায়িফুল মায়ারিফ পৃষ্ঠা : ৩২৭)। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘শীতকালকে মোবারকবাদ। এতে বরকতের ঝরনাধারা নাজিল হয়। রাত দীর্ঘ হয় কিয়ামুল্লাইলের জন্য। আর দিন ছোট হয় রোজা রাখার জন্য।’ (লাতায়িফুল মায়ারিফ, পৃষ্ঠা : ৩২৭)

শীতে যেন বান্দার অজুতে কষ্ট না হয়, সেজন্য চামড়ার মোজায় মাসেহের সময়সীমা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শীতে চামড়ার মোজা পরিধান করা এবং অজুর সময় পা না ধুয়ে মোজার ওপর মাসেহ করা আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য বিশেষ ছাড়। বান্দা হিসেবে মালিকের এ ছাড় গ্রহণ করা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর সাধারণ বিধানের পাশাপাশি ছাড়ের বিধানগুলোর ওপর আমল করা তিনি পছন্দ করেন।’ (মুসনাদে আহমদ : ৫৮৩২)। চামড়ার মোজায় মাসেহ করা শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ বিধান। পূর্ণ অজু অবস্থায় মোজা পরিধান করার পর অজু নষ্ট হওয়ার সময় থেকে নিয়ে বাড়িতে অবস্থানকালে (ইকামত) এক দিন এক রাত আর সফর অবস্থায় তিন দিন তিন রাত মাসেহ করার বিধান আছে। অজুতে পা ধোয়ার পরিবর্তে তিন আঙুল ভিজিয়ে, উভয় মোজার ওপর টাখনু পর্যন্ত টান দেওয়া। যদিও বছরজুড়েই এ আমল করা যায়। তবে শীতে এর সুযোগ বেশি। হজরত আলি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) মোজার ওপর মাসেহের মেয়াদ মুকিমের জন্য এক দিন এক রাত এবং মুসাফিরের জন্য তিন দিন তিন রাত নির্ধারণ করেছেন।’ (মুসলিম : ২৭৬)

এ ছাড়া শীত মৌসুমে আমরা আল্লাহতায়ালার অসংখ্য নেয়ামত ভোগ করে থাকি। অনেকেই হেমন্তের শেষ ভাগ ও শীতকে মনে করেন পিঠা-পায়েসের মহোৎসব। কুয়াশাযুক্ত হিমশীতল সকালে পিঠা খেতে কার না ভালো লাগে। গ্রামে কী শহরে—সবখানে চলে পিঠা উৎসব। নতুন ধানের চালের গুঁড়ি আর খেজুর গুড় দিয়ে বানানো পিঠা ছোট-বড় সবার পছন্দ। খেজুরের গুড় আর নতুন চাল দিয়ে তৈরি হয় মজাদার পিঠাপুলি। এই পিঠা, পায়েস, খেজুরের রস, গুড় এবং বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি, তরিতরকারি ও শীত নিবারণের বস্ত্রাদি সবই মহান আল্লাহর দান। আল্লাহ আমাদের এসব নেয়ামত দান করেছেন। আমাদের উচিত, মেহেরবান রবের শুকরিয়া আদায় করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় করো, তাহলে আমি তোমাদের নেয়ামত আরও বাড়িয়ে দেব।’ (সুরা ইব্রাহিম : ৭)

শীতকাল মুমিনের বসন্ত হওয়া সত্ত্বেও বহু মানুষ এ সময়ে ইবাদত-বন্দেগি থেকে বিরত থাকে। অলসতার চাদর মুড়ি দিয়ে রাত কাটিয়ে দেয়। এমনকি এশা ও ফজরের নামাজ আদায়েও উদাসীনতা প্রদর্শন করে। শীতের রাতে ঠান্ডা পানি দিয়ে অজু করতে কষ্ট হয় বিধায় নামাজ আদায়ে অলসতা পেয়ে বসে। তাদের জানা উচিত—ঠান্ডা পানি দিয়ে পরিপূর্ণরূপে অজু করা সর্বোৎকৃষ্ট আমল। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, একদা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমি কি এমন আমলের কথা জানাব না! যার দ্বারা আল্লাহতায়ালা তোমাদের পাপগুলো মার্জনা করে দেবেন এবং আখেরাতে তোমাদের উচ্চমর্যাদা দান করবেন। সাহাবারা আরজ করেন, অবশ্যই বলুন। তিনি তখন বললেন, ‘কষ্টের সময় পূর্ণরূপে অজু করা, মসজিদে বেশি বেশি গমন করা এবং এক নামাজ আদায়ের পর পরবর্তী নামাজের অপেক্ষায় থাকা। এটা রিবাততুল্য ইবাদত।’ (বুখারি : ৫৭৪; মুসলিম : ৬৩৫)

অতএব, আসুন শীতের এই হিমেল পরিবেশে বিশেষ ইবাদতের প্রস্তুতি গ্রহণ করি এবং পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে অর্জন করি সৃষ্টির পক্ষ থেকে দোয়া এবং স্রষ্টার পক্ষ থেকে সওয়াব। শীতের উষ্ণতায় যদি সঞ্চয় করে নিতে পারি পরকালের সম্পদ, ক্ষতি কী?

লেখক : মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নিয়োগ দিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, থাকছে না বয়সসীমা

জালালাবাদ গ্যাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মুখ খুললেন ব্যারিস্টার সুমন

গোসল করতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন যুবক

রাতে ঢাকাসহ ৮ জেলায় ঝড়ের শঙ্কা

বিএনপির পর্তুগাল শাখার নতুন কমিটির অভিষেক ও পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত

‘ক্ষমতা সবার হাতে নিরাপদ নয়’

রূপায়ণ সিটি ও ডেলকো বিজনেস অ্যাসোসিয়েট লিমিটেডের চুক্তি স্বাক্ষর

ভোটের পরিবেশ নষ্ট করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা : রাজশাহীর ডিসি

ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজের ২ ইউনিটের ফল প্রকাশ

অনুমোদনহীন ৫ ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস, মালিকদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

১০

কাবিখা প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে চেয়ারম্যানসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা

১১

মৃত কন্যার বিয়ের জন্য মৃত পাত্র খুঁজছেন বাবা-মা

১২

সর্বজনীন পেনশন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম প্রত্যাহারের দাবি বেরোবি শিক্ষক সমিতির

১৩

নিজের উদ্ভাবিত চিকিৎসায় ক্যানসার থেকে বেঁচে ফিরলেন চিকিৎসক

১৪

আজ অনলাইনে রোমান্স করার দিন

১৫

জিম্মির এক মাস কেমন কেটেছে জানালেন নাবিকরা

১৬

গ্লোবাল সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার অ্যাওয়ার্ড পাচ্ছেন বাংলাদেশের জুবায়ের

১৭

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে বিকল ৩ ট্রেন

১৮

চীনা নাগরিকের মাথা ফাটিয়ে পালাল ডাকাত

১৯

নারী উন্নয়নে বাংলাদেশের পদক্ষেপের প্রশংসায় জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি

২০
X