কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৫ মে ২০২৪, ০২:০৮ এএম
আপডেট : ০৫ মে ২০২৪, ০৭:৪৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ক্ষতিকর নানা গ্যাস ঢাকার বাতাসে উত্তাপ বাড়াচ্ছে

বিআইপির সংলাপে বক্তারা
ক্ষতিকর নানা গ্যাস ঢাকার বাতাসে উত্তাপ বাড়াচ্ছে

রাজধানী ঢাকায় কয়েক দশক আগেও নগর পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণ সবুজ এলাকা ও জলাশয় ছিল। কিন্তু পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে খাল-পুকুর ভরাট, দখল ও ধ্বংস, সবুজ এলাকা নষ্ট করে অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণে কংক্রিটের জঞ্জাল বেড়েছে। নগরীর ভবনের নকশায় পরিবেশ ও জলবায়ুর ধারণা বাদ দিয়ে কাচ নির্মিত ভবন ও এসিনির্ভর ভবনের নকশা তৈরি করা হয়েছে। সঙ্গে নগরীতে কোনো ধরনের বনায়ন করা হয়নি। নগর এলাকায় সরু রাস্তার পাশেই সুউচ্চ ভবন নির্মাণ, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো কর্তৃক জলাশয়-জলাধার-সবুজ এলাকা ধ্বংস করা হচ্ছে। ময়লার ভাগাড়, ইটভাটা, যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া থেকে সৃষ্ট বায়ুদূষণে নগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি বায়ুদূষণে সৃষ্ট অতি ক্ষুদ্র কণার কারণে নগরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকার বাতাসে উত্তাপ বাড়াচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর গ্যাস। ময়লার ভাগাড়, ইটভাটা, যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া থেকে তৈরি হচ্ছে গ্যাস।

গতকাল শনিবার বাংলামোটরে প্ল্যানার্স টাওয়ারের বিআইপি কনফারেন্স হলরুমে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) উদ্যোগে ‘ঢাকায় তাপদাহ: নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার দায় ও করণীয়’ শীর্ষক পরিকল্পনা সংলাপে এসব তথ্য উঠে আসে। সংলাপের শুরুতে বিআইপির সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসানের সঞ্চালনায় মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ইনস্টিটিউটের সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান।

প্রতিবেদনে তিনি বলেন, ঢাকা শহরে সবুজ যেমন কমেছে, ঠিক তেমনি গত দুই দশকে বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত ধূসর এলাকা ও কংক্রিটের পরিমাণ, যা নগর এলাকায় তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে মারাত্মক হারে, বাড়ছে আরবান হিট আইল্যান্ডের প্রভাব। ২০১৯ সালে করা বিআইপির গবেষণা অনুসারে, কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকা ১৯৯৯ সালে ছিল ৬৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ, ২০০৯ সালে বেড়ে হয় ৭৭ দশমিক ১৮ শতাংশ, আর ২০১৯ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৮১ দশমিক ৮২ শতাংশে।

২০২৩ সালে বিআইপির প্রকাশিত আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২৮ বছরে রাজধানী ঢাকার সবুজ এলাকা কমে মাত্র ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে; অন্যদিকে জলাভূমি নেমে এসেছে মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশে। যদিও নগর পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি আদর্শ শহরে ২৫ শতাংশ সবুজ এলাকা এবং ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জলাশয়-জলাধার থাকার কথা। এরই পাশাপাশি ভবনের নকশায় প্রাকৃতিক আলো-বাতাস চলাচলকে ব্যাহত করে দিয়ে আবদ্ধ ঘর, কাচ নির্মিত ঘর ও এসি ব্যবহারকে মাথায় রেখে ভবন নির্মাণের প্রবণতার কারণে মহানগরীতে তাপমাত্রা বাড়ছে।

শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে পুরো পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১ থেকে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির কথা বলা হলেও ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় এ তাপমাত্রা ৫ থেকে ৬ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে। যার মূল কারণ মূলত ঢাকা শহরের আশপাশের প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার এবং নগরায়ণের নামে চালানো ধ্বংসযোগ্য।

তিনি বলেন, ডেল্টা প্ল্যান, জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা এবং অন্যান্য যেসব নীতিমালা রয়েছে, তার যথাযথ চর্চায় নিয়ে আসতে হবে এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সংযোগ রেখে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। তা ছাড়া বিভিন্ন ধরনের যেসব জলবায়ুকেন্দ্রিক পলিসি অথবা নীতিমালা রয়েছে, সবগুলোকে একসঙ্গে করে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। তা ছাড়া যে কোনো পরিকল্পনা বা মেগা প্রকল্প শুরু করার আগে রাজউকের মাস্টার প্ল্যান অনুসরণ করছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। সঙ্গে এসব প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কাজে পরিকল্পনাবিদদের যুক্ত করতে হবে।

এরই মধ্যে ঢাকা শহরের বায়ুর মানদণ্ড পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অত্যন্ত নিম্নমানের মন্তব্য করেন বিআইপির ন্যাশনাল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল লিয়াজোঁ পরিকল্পনাবিদ আবু নাইম সোহাগ। তিনি বলেন, প্রতিনিয়ত নগরায়ণের নামে এসব পার্ক উদ্যান এবং জলাভূমি ভরাট করা হচ্ছে, যা আমাদের ঢাকা শহরে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে অন্যতম কারণ। তা ছাড়া ঢাকা শহরে এসি ব্যবহারে যে বাণিজ্যিক চিন্তাভাবনা গড়ে উঠেছে, তা থেকে আমাদের যত দ্রুত সম্ভব সরে আসতে হবে।

বিআইপির বোর্ড সদস্য পরিকল্পনাবিদ হোসনে আরা বলেন, ঢাকার তাপপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে এবং তাপ সহনশীল নগর হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে আরবান হিট মিটিগেশন ও ম্যানেজমেন্ট কৌশল নগর পরিকল্পনায় সর্বোচ্চ বিবেচনায় আনতে হবে।

পরিকল্পনাবিদ রেদওয়ানুর রহমান বলেন, ঢাকা শহরে পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ জনগণ মূলত এসি ব্যবহার করে থাকে, যা আমাদের ঢাকা শহরের তাপমাত্রা পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ পাশাপাশি আমাদের জলবায়ুর ক্ষতি সাধন করছে।

পরিকল্পনা সংলাপে ড. আদিল মুহাম্মদ খান ঢাকা মহানগরীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে বিআইপির পক্ষ থেকে ২৩ দফা প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন। তাদের প্রস্তাবনায় রয়েছে, সবুজ ও জলাশয় এলাকা সংরক্ষণে যথাযথ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন, জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, হারিয়ে যাওয়া খালবিল-জলাশয়-জলাভূমি ও সবুজ বাস্তবতার নিরিখে সম্ভাব্যতা যাচাই সাপেক্ষে পুনরুদ্ধার, ধ্বংসকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা, নগর পরিকল্পনা ও ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনার মাধ্যমে সবুজ এলাকা, জলাশয় ও কংক্রিট এলাকার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হওয়া, নগর এলাকার প্রান্তে সবুজ বেষ্টনী প্রকল্প গ্রহণ, ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জলাশয় ও জলাধার রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করা, সরু রাস্তার পাশে সুউচ্চ ভবন নির্মাণ প্রবণতা বন্ধ করা, বেসরকারি আবাসিক প্রকল্পের বিধিমালা সংশোধন করে সবুজ ও জলাশয় এলাকা, পার্ক-উদ্যান-খেলার মাঠ বাড়ানোর যথাযথ উদ্যোগ, বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা প্রস্তাবিত জলকেন্দ্রিক পার্ক, ইকোপার্ক, পার্ক, খেলার মাঠ তৈরিতে দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, মেগা প্রকল্প ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে নগর সংস্থাগুলোর মধ্যে কার্যকর সমন্বয় নিশ্চিত করা, এসির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও সীমিত করতে প্রয়োজনীয় নীতিমালা এবং নির্দেশনা প্রণয়ন করা, এনার্জি এফিশিয়েন্ট ভবন ও গ্রিন বিল্ডিং কোড প্রণয়ন করা, ভবনের ডিজাইনে প্রাকৃতিক আলো-বাতাস চলাচল ও এনার্জি এফিশিয়েন্সির বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া, প্রান্তিক, নিম্ন আয় ও বস্তি এলাকার মানুষের আবাসন পরিকল্পনা, নগর এলাকায় সবুজ ও জলাশয় রক্ষা করতে কমিউনিটিভিত্তিক সংগঠন সৃষ্টি ও কমিউনিটিভিত্তিক নজরদারি বাড়ানো। ওয়ার্ডভিত্তিক মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করা, তাপমাত্রা ও তাপপ্রবাহ বিবেচনায় নিয়ে নগর পরিকল্পনা ও ভবনের নকশা এবং নির্মাণ নিশ্চিত করতে পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, প্রকৌশলী, উদ্যানতত্ত্ববিদদের অন্তর্ভুক্তি ও সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব থেকে উদ্ধার পেতে ঢাকা মহানগরীর পরিকল্পনা এবং উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা-২০২২-এর সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে এবং এজন্য এসব প্রতিষ্ঠানে পরিকল্পনাবিদসহ প্রয়োজনীয় কারিগরি জনবল বৃদ্ধি করতে হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পেঁয়াজ চুরির অভিযোগে সাবেক ইউপি সদস্যকে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন

গ্রীন লাইফ হাসপাতালে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ

ফরিদপুরের ডিসি / ‘বুলেট থাকতে ব্যালটে কেউ হাত দিতে পারবে না’

হেরে যাচ্ছে ইসরায়েল, বিস্ফোরক মন্তব্য মোসাদের সাবেক উপপ্রধানের

যে কারণে ডিবিতে এসেছিলেন মামুনুল হক

অর্থনীতিকে ধারণ করার সক্ষমতা হারাচ্ছে ব্যাংকিং খাত : ফাহমিদা খাতুন

নাটোরে গৃহবধূর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

‘বাংলাদেশ ব্যাংক কি নিষিদ্ধ পল্লী?’

সমবায়ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা জোরদারে এগিয়ে আসতে হবে : প্রতিমন্ত্রী

মাগুরায় রেলপথ শিগগিরই চালু হবে : রেলমন্ত্রী

১০

ইঞ্জিনিয়ার নিচ্ছে ইজি ফ্যাশন, পদসংখ্যা অনির্ধারিত

১১

ওসি জাহাঙ্গীরের চাঁদার টাকা রফাদফার ভিডিও ভাইরাল

১২

ঢাকায় অনুষ্ঠিত হলো মিডিয়া সামিট 

১৩

কানাডা ও জাপান সফরে গেলেন গণপূর্তমন্ত্রী

১৪

ঘূর্ণিঝড় রেমাল নিয়ে ভয়ংকর তথ্য

১৫

মহাসড়কে অভিযান / বগুড়ায় ১৪ গাড়ি থেকে হাইড্রোলিক হর্ন খুলে নিল পুলিশ

১৬

স্কুল ব্যাগে মিলল ৫২০০ পিস ইয়াবা, যুবক গ্রেপ্তার

১৭

ডিবিতে মামুনুল হক

১৮

পার্লামেন্টে এমপিদের মধ্যে তুমুল মারামারি

১৯

ঢাবির জাতীয় ছায়া জাতিসংঘ অধিবেশন ৩০ মে শুরু

২০
X