লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২৪, ০১:৫৫ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

গুলিতে শেষ এতিম নুরনাহারের সুখের সংসার

গুলিতে নিহত মো. ফয়েজ। ছবি : সংগৃহীত
গুলিতে নিহত মো. ফয়েজ। ছবি : সংগৃহীত

ভালোবেসে এতিম নুরনাহার বেগমকে বিয়ে করেন স্যানিটারি মিস্ত্রি মো. ফয়েজ। তাদের সংসারে ফুটফুটে একটি ছেলেসন্তানের জন্ম হয়। ঢাকায় একটি ভাড়া বাসায় তাদের সংসারজীবন ভালোই কাটছিল। পৃথিবীতে নুরনাহারের একমাত্র আপনজন ছিল তার স্বামী। সেই আপনজনকে কেড়ে নিয়েছে দুটি গুলি। যে গুলিতে নিভে যায় ফয়েজের (৩২) তাজা প্রাণ। ফয়েজের মৃত্যুতে অন্ধকারে ঢেকে গেল সুখের সংসার। নুরনাহারও পৃথিবীতে এখন ফের একা হয়ে গেলেন। একমাত্র সন্তান রাফি মাহমুদকে নিয়েও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তিনি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় যাত্রাবাড়ী সাইনবোর্ড এলাকায় মারা যান ফয়েজ।

ফয়েজ লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার উত্তর চর আবাবিলের ইউনিয়নের পশ্চিম ঝাউডগি গ্রামের কাঠমিস্ত্রি আলা উদ্দিনের ছেলে। তিনি ঢাকায় স্যানিটারি মিস্ত্রি হিসেবে দৈনিক হাজিরায় কাজ করতেন। ২১ জুলাই সন্ধ্যা ৬টার দিকে কাজ শেষে ভাড়া বাসায় যাওয়ার পথে যাত্রাবাড়ী সাইনবোর্ড এলাকায় গুলিতে মারা যান তিনি।

জানা গেছে, নিম্ন মধ্যবিত্ত সংসারে ফয়েজের জন্ম। এতে অল্প বয়সেই কাজের উদ্দেশে মালদ্বীপ যান তিনি। করোনায় ২০২০ সালে চাকরি হারিয়ে বাড়ি ফিরতে হয় তাকে। ফের পরিবারের হাল ধরতে চাকরি খুঁজতে তিনি ঢাকায় যান। সেখানে স্যানিটারি মিস্ত্রি (পাইপ ফিটিংস) হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরমধ্যে গাজীপুরের টঙ্গীর বাসিন্দা এতিম নুরনাহারকে ভালোবেসে বিয়ে করেন। ১৮ মাস আগে তাদের সংসারে একটি পুত্রসন্তান জন্ম নেয়। তার নাম রাফি মাহমুদ।

ঘটনার পর গুলিবিদ্ধ ফয়েজকে তার পরিচিত স্যানিটারি ঠিকাদার মো. কাশেম হাসপাতালে নিয়েছিলেন। ফোনে কথা হয় তার সঙ্গেও। তিনি বলেন, অ্যাম্বুলেন্সে করে প্রথমে ফয়েজকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার মাথা ও ঘাড়ে গুলি লাগে। পরে তার মরদেহ লক্ষ্মীপুরের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। ফয়েজ খুব শান্ত ও ভদ্র স্বভাবের ছিল। দৈনিক ৭০০ টাকা তিনি মজুরি পেতেন। ওই টাকায় স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে তিনি যাত্রাবাড়ী সাইনবোর্ড এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন।

ফয়েজের মা সবুরা বেগম বলেন, ঘটনার আগমুহূর্তে আমি ফয়েজকে কল দিয়েছি। সে বলছিল কাজ শেষে বাসায় যাচ্ছে। পরে আবার কল দিয়ে বলে, ‘মা রাস্তায় অনবরত গুলি হচ্ছে। এখন ফোন রাখ’। কথা শেষ না হতেই বিকট শব্দ শুনতে পাই। এরপর আর তার কথা শুনতে পাইনি। বারবার কল দিলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

এদিকে স্বামীকে হারিয়ে পৃথিবীতে ফের একা হয়ে গেলেন নুর নাহার। শ্বশুরবাড়ির লোকজন গরিব হওয়ায় সেখানেই ঠাঁই নিতে পারেননি তিনি। স্বামীর মরদেহ দাফন শেষে শিশু রাফিকে বুকে নিয়ে গাজীপুরের টঙ্গী এলাকায় ফিরতে হয় তাকে। মুঠোফোনে নুরনাহার বলেন, বাবা-মা, ভাইবোন কেউই নেই। ফয়েজ আমাকে বিয়ে করে আপনজন করে নিয়েছিল। ফয়েজই পৃথিবীতে আমার একমাত্র আপনজন ছিল। সে আমার একমাত্র আশ্রয় ছিল। তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। এখন আমার আর কেউ নেই। কে দেখবে আমাকে ও আমার ছোট্ট রাফিকে। কী দোষ ছিল ফয়েজের, কে দেবে এর জবাব? আমি এখন বড় একা।

নুরনাহার আরও বলেন, শ্বশুরবাড়ির লোকজনও গরিব। সেখানে আশ্রয় নিয়েও ফয়েজের মরদেহ দাফন শেষে টঙ্গীতে এক খালার বাসায় এসে আশ্রয় নিয়েছি। খালাও অসুস্থ, তার পরিবারও থাকে অর্ধহারে অনাহারে। এসব বলেই কান্নায় তিনি ভেঙে পড়েন। এরপর তিনি আর কোন কথা বলতে পারেননি।

নুরনাহারের খালা বৃদ্ধা হাজেরা বেগম বলেন, আমি অন্ধ ও অসুস্থ। আমার একমাত্র ছেলেটিও পঙ্গু। আমাদের ওপর আল্লাহ এত নির্দয় কেন? এত কষ্ট নিয়ে আমরা কোথায় যাব? নুরনাহার ও তার ছেলেটার দিকে আপনারা সবাই দেখবেন। আমাদের কেউ নেই। এরপর শুধু কান্নার আওয়াজ ছাড়া আর কোনো কথা শোনা যায়নি।

অন্যদিকে ফয়েজের মা সবুরা বেগম ও বাবা আলা উদ্দিন ছেলের শোকে অনবরত কান্না করছেন। ছেলের মৃত্যুর ৯ দিন পার হলেও তাদের কান্না থামেনি। ফয়েজ ছিল তাদের তিন ছেলেমেয়ের সবার বড়। তার কবরের পাশে বারবার ছুটে যাচ্ছেন মা সবুরা। আর ছেলের শোকে হাউমাউ করে কাঁদছেন। প্রতিবেশীরাও তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না।

ফয়েজের বাবা আলাউদ্দিন বলেন, ফয়েজ শ্রমিক ছিল। কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। কী দোষে তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। সেত আর ফিরে আসবে না। তার স্ত্রী-সন্তানকে কে দেখবে। বউটাও এতিম। আমি চট্টগ্রাম পোর্টে চাকরি করতাম। সেনা সরকারের সময় এক আন্দোলনে চাকরি হারিয়েছি। এবার আরেক আন্দোলনে আমার ছেলেকে হারালাম। কে বা কার আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ছোড়া দুটি গুলি আমার ছেলেটাকে শেষ করে দিল। আমি ফয়েজ হত্যার বিচার কার কাছে চাইব?

প্রসঙ্গত, ২১ জুলাই সন্ধ্যায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর সাইনবোর্ড এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন ফয়েজ। আহত অবস্থায় ফয়েজকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ২২ জুলাই জানাজা শেষে ফয়েজের মরদেহ পশ্চিম ঝাউডগি গ্রামের বাড়ির পাশে দাফন করা হয়।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

ঘটনাপ্রবাহ: কোটা সংস্কার আন্দোলন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ফুটবল ও ক্রিকেট, দুই বিশ্বকাপেই খেলবে যেসব দেশ

চুল পড়া আর খুশকির সমস্যা বাড়াচ্ছেন নিজের ৬ অভ্যাসে

তাসফিনের হাত পুনঃসংযোজন এক বিরল সাফল্য : রিজভী

অভিযানে আটকের পর বহিষ্কৃত যুবদল নেতার মৃত্যু

নির্বাচনে জনগণই তাদের ভোট পাহারা দেবে : সালাহউদ্দিন আহমদ

কারাবন্দি ইমরান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করল পাকিস্তান সরকার

১ যুগের নতুন দিগন্তে কুবিসাস

তারেক রহমানের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি : আমীর খসরু 

দুর্যোগ মোকাবিলায় স্কাউটদের ভূমিকা অনন্য : শিক্ষা উপদেষ্টা

আইজিপি বাহারুলকে বরখাস্তের দাবিতে প্রধান উপদেষ্টাকে আইনজীবীর চিঠি

১০

নেইমারের বিশ্বকাপ খেলা নিয়ে নতুন তথ্য জানালেন আনচেলত্তি

১১

ভারতে আজহারির নামে ‘মাহফিলের’ প্রচারণা, যা জানা গেল

১২

পুলিশ সদস্যের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

১৩

অতিরিক্ত খাওয়া থামানোর সহজ ১০ উপায়

১৪

ভারত বাদ, বাংলাদেশ-চীনকে নিয়ে জোটের প্রস্তাব পাকিস্তানের

১৫

ফুটবল বিশ্বকাপে ফিফার নিরপেক্ষতা নিয়ে গুরুতর বিতর্ক

১৬

পাকিস্তান আফগানিস্তান সীমান্তে তীব্র গোলাগুলি, নিহত ৪

১৭

ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে স্টোর অফিসার নিহত

১৮

পঞ্চগড়ে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা, স্থবির জনজীবন

১৯

ফিফার শান্তি পুরস্কার পেলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

২০
X