মায়ের লাল ওড়না মাথায় পেঁচিয়ে, মায়ের দোয়া নিয়ে আন্দোলনে যান শ্রাবণ। নিজের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে দেশকে স্বৈরাচার মুক্ত করলেন। মা-বাবা হারাল তাদের বুকের ধন। শ্রাবণের স্বপ্ন ছিল প্রথম রোজগার করে মা-বাবা ও নানিকে হজ করাবেন। উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকা গিয়ে ডিগ্রি অর্জন করবেন। বিদেশ গিয়ে পরিবারের হাল ধরবেন শ্রাবণ- ছিল এমনই আশা।
পরিবারের সেই আশা দুঃস্বপ্ন হয়ে গেল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে গত ৪ আগস্ট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনীর মহিপালে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন ফেনী সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছাত্র সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ।
ফেনী পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের গাজীক্রস রোডের দোস্ত মোহাম্মদ ঐতিহ্যবাহী ভূঁইয়া বাড়িতে ২০০৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর জম্ম হয় শ্রাবণের। ২০২২ সালে ফেনী সরকারি পাইলট হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ২০২৪ সালে ফেনী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ৭টি পরীক্ষায়ও অংশগ্রহণ করে। তিন ভাই-বোনের মধ্যে শ্রাবণ সবার বড়। মেজ বোন উসাইমা ইয়াকিন (১৪) অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে ও ছোট বোন আকসা ইয়াকিন (২)। বাবা নেছার আহম্মদ বেসরকারি চাকরিজীবী। মা ফাতেমা আক্তার গৃহিণী।
জানা যায়, আন্দোলনের শুরু থেকেই শ্রাবণ সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। ঘটনার দিন ৪ আগস্টও সকাল থেকে তারা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ফেনীর মহিপাল ফ্লাইওভারের নিচে অবস্থান নেন। দুপুর আনুমানিক ২টার দিকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অতর্কিতভাবে চারদিক ঘেরাও করে নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর গুলি করতে থাকে। আটটি গুলি এসে বিঁধে শ্রাবণের বুকে-পিঠে, কানে ও একটি হাতে। পরে কয়েকজন মিলে তাৎক্ষণিক শ্রাবণকে উদ্ধার করে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এরপর হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে ফেনী পৌর শহরের ৭নং ওয়ার্ডে বাসায় ফিরে এলে দ্রুত সময়ের মধ্যে লাশ দাফন করতে বারবার চাপ প্রয়োগ করা হয়। পরে অল্প সময়ের মধ্যে স্থানীয় অচিন গাছতলায় তার নানা বাড়ির সামনে প্রথম জানাজা, পরে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার দক্ষিণ আনন্দপুর গ্রামে তার দাদাবাড়ির নিকটবর্তী পারিবারিক কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়।
এ ঘটনায় মাসুদের মা ফাতেমা আক্তার ফেনী-২ সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীকে প্রধান আসামি করে ১০৫ জনের নামোল্লেখ করে ফেনী মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
শ্রাবণের বাবা নেছার আহমেদ বলেন, আমি কীভাবে থাকব। সময় যত যাচ্ছে কষ্ট যেন আমার বুকে পাথর হয়ে আরও বড় হচ্ছে। আমার সন্তানের জন্য গ্রামে না থেকে শহরের ভাড়া বাসায় থেকে তাদের পড়ালেখা করিয়ে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন বুনেছি।
শ্রাবণের মা ফাতেমা আক্তার বলেন, আমার লাল ওড়না মাথায় পেঁচিয়ে আন্দোলনে যায় শ্রাবণ। তাকে নরপিশাচরা বুকে-পিঠে, কানে, হাতে আটটি গুলি মেরে হত্যা করে। মৃত্যুর সময় কত কষ্ট পেয়েছে আমার শ্রাবণ। আমি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।
মন্তব্য করুন