নরসিংদীর রায়পুরায় মেঘনা নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ নিয়ে চলছে ইঁদুর-বিড়াল খেলা। অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করলেই তাদের ওপর চলে গুলিবর্ষণ ও ককটেল নিক্ষেপ। অভিযান সম্পন্ন না করেই ফিরে আসে অভিযান টিম। এমন ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে রায়পুরায়।
গত ১৫ জানুয়ারি এবং ১৯ মে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ওপর গুলিবষর্ণের ঘটনা ঘটলেও এখন পর্যন্ত থানায় কোনো মামলা হয়নি। আটক নেই একজনও। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মনে দেখা দিয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া।
স্থানীয়রা জানান, প্রতিনিয়ত নদী থেকে বালু খেকোরা অবৈধভাবে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করছে। তাদের বাধা দেওয়ার মতো কেউ নেই। এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে প্রশাসনকে অবহিত করলে কিংবা ওপর মহল থেকে বালু উত্তোলন বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চাপ দিলে প্রশাসন নামমাত্র অভিযান পরিচালনা করে।
তারা আরও জানায়, ৩০/৩৫টি ড্রেজারের মাধ্যমে নদী থেকে বালু উত্তোলন করলেও অভিযান পরিচালনাকালে ভ্রাম্যমাণ আদালত মাত্র একটি বা দুটি ড্রেজার জব্দ করে এবং নামমাত্র জরিমানা ধার্য করে। তবে পরে আবার এসব জব্দ করা ড্রেজার ছাড়িয়েও নিয়ে যায় ড্রেজার মালিক। এমনভাবে চলতে থাকলে একদিন হয়তো রায়পুরা উপজেলার অনেক গ্রাম নদীগর্ভে চলে যাবে।
জানা গেছে, এর আগে ২০২৪ সালের ১৫ নভেম্বর একই উপজেলার মির্জারচর ইউনিয়নের শান্তিপুর গ্রামের মেঘনা নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সময় গ্রামবাসী একটি ড্রেজার আটক করে। গ্রামবাসীর উপর গুলি ছুড়তে ছুড়তে ছত্রভঙ্গ করে আটক ড্রেজারটি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি একই উপজেলার মেঘনা নদীর মাঝেরচর এলাকা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে বাধা দেওয়ায় বালু খেকোদের হামলায় ১০ জন গ্রামবাসী আহত হয়েছেন।
১৬ জানুয়ারি একই এলাকায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে অভিযানে গেলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ওপর ড্রেজার থেকে ১০/১২টি গুলি ছোড়া হয়েছে। এতে অল্পের জন্য গুলিবিদ্ধ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), সহকারী কমিশনার (ভূমি) (এসি ল্যান্ড), জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ অন্তত ২৫ জন।
গত ১৯ মে বিকেলে মেঘনা নদীতে এমনই এক অসম্পন্ন অভিযান পরিচালনা করে রায়পুরা উপজেলা প্রশাসন। এ অভিযানেও ভ্রাম্যমাণ আদালতের টিমকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ ও ককটেল নিক্ষেপ করে বালু খেকোরা।
রায়পুরা থানার ওসি আদিল মাহমুদ বলেন, গত ১৫ জানুয়ারি এবং ১৯ মে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ওপর গুলিবষর্ণের ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। কাউকে আটকও করা যায়নি। কেন মামলা হয়নি তা জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, এটা ইউএনও বলতে পারবেন, তিনিই তো ভ্রাম্যমাণ আদালতের প্রধান। আমাদের কাছে পুলিশ চেয়েছে আমরা পুলিশ সদস্য দিয়েছি। এর বেশি কিছু জানি না।
রায়পুরা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাসুদুর রহমান রুবেল বলেন, গোপন সূত্রে জানতে পারি রায়পুরা উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চলের চরমধুয়া ইউনিয়নের মেঘনা নদীতে কয়েকটি ড্রেজারের মাধ্যমে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিকেলে আমরা জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটসহ চরমধুয়া ইউনিয়নের মেঘনা নদীতে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে অভিযান পরিচালনা করতে যাই।
তিনি আরও বলেন, অভিযানকালে দূর থেকে আমাদের দেখে বালু উত্তোলনকারীরা ড্রেজারসহ পালাতে থাকে। এ সময় তাদের ধাওয়া দিলে দুটি ড্রেজার থেকে কয়েক রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। পরে তারা পালিয়ে যাওয়ার সময় নদীর তীরে ও পাশের ঝোপ-জঙ্গলে অবস্থান নিয়ে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় এবং গুলিবর্ষণ করে। অবস্থা অনিয়ন্ত্রিত হওয়ার কারণে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সদস্যদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অভিযান বন্ধ করে ফেরত চলে আসি।
সহকারী কমিশনার বলেন, এ অবৈধ বালুখেকোদের সন্ত্রাসীরা আগ্নেয়াস্ত্রসহ দলবদ্ধভাবে অবস্থান নিয়ে থাকে। তাই ভবিষ্যতে এসব বালু সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে বড় পরিসরে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
রায়পুরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাসুদ রানা বলেন, অভিযান পরিচালনাকালে ভ্রাম্যমাণ আদালত বালুখেকোদের ধাওয়া দিলে তারা ঝোপ-জঙ্গলে অবস্থান নিয়ে গুলিবর্ষণ করে। এতে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান বন্ধ করে চলে আসে।
গত ১৫ জানুয়ারি এবং ১৯ মে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ওপর গুলিবষর্ণের ঘটনায় মামলা এবং গ্রেপ্তার হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, প্রত্যক্ষদর্শী কাউকে মামলা করতে বলা হয়, মামলা হয়তো করেনি, ভয় পায়। সাধারণ মানুষ ভয় পায় বলে, পুলিশকে বাদি হয়ে মামলা করতে বলা হয়। পুলিশ তো এ ঘটনার সময় উপস্থিত ছিল, পুলিশ ইচ্ছে করলে মামলা করতে পারে। আমি রায়পুরা থানার ওসি সাহেবকে মামলা করতে বলেছিলাম।
ইউএনও আরও বলেন, এসব ঘটনায় সেনাবাহিনী, র্যাবকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারাও তো তাদের গ্রেপ্তার করে না। এটাতো শুধু ইউএনও, এসিল্যান্ড বা ডিসি সাহেবের একার কাজ না, সমন্বিত কাজ।
এসব ঘটনায় কেন মামলা হয়নি জানতে চাইলে মাসুদ রানা বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের উপর উভয় গুলি বর্ষণের ঘটনার সময়ই তো পুলিশ উপস্থিত ছিল, পুলিশের উপস্থিতিতেই গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ তো চাইলে মামলা করতে পারে, একজন ম্যাজিস্ট্রেট তো আর মামলা করবে না। এ ছাড়া মামলা বিষয়টি আসলে মুখ্য বিষয় না, মুখ্য বিষয় হলো তাদেরকে শনাক্ত করা।
নরসিংদী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ হোসেন চৌধুরী বলেন, উভয় ঘটনায় রায়পুরা থানা পুলিশকে মামলা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে কেন মামলা করেননি রায়পুরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে একটু জেনে নিন।
মন্তব্য করুন