চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ইউনিয়নের ভূঁইয়া টিলা এলাকা থেকে পৌরসভার গোভনিয়া খালের আশপাশে পাঁচ শতাধিক পরিবারের বসবাস। বাপদাদার আমল থেকেই সেখানে তাদের বসতভিটা কিংবা আবাস নীড়। রয়েছে কৃষিজমি, গাছপালাসহ আরও বহু প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এক রাতের ব্যবধানে সব বিলীন হয়ে গেছে তাদের। মাসখানেক আগে এক সকালে হঠাৎ করে ড্রেজার দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে কৃষিজমি, বসতভিটাসহ হাজার হাজার গাছপালা। আকস্মিক এই বিপদে দিশেহারা সেখানকার মানুষ। উপায়ান্তর না দেখে তারা ছুটলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে। কিন্তু আজও এর প্রতিকার পাননি তারা।
মূলত জলাবদ্ধতা নিরসন ও কৃষি উৎপাদন বাড়াতে ৮ কিলোমিটার খাল সংস্কার করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। এত বড় সিদ্ধান্তের আগে স্থানীয়দের সঙ্গে কোনো আলোচনাই করেনি সংস্থাটি; দেয়নি কোনো ক্ষতিপূরণ।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ছড়াটি বিএস দাগ নম্বর ১০৬৮৯ ও অন্যান্য দাগে রয়েছে। এর আগেও একাধিকবার খালটি খনন করা হয়েছিল। এবার সীমানা নির্ধারণ ছাড়াই খনন করতে গিয়ে পাঁচ শতাধিক মানুষের কৃষিজমি, বসতভিটা, চলাচলের রাস্তা ও শত শত গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এ জন্য কোনো নোটিশ বা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। খনন কাজ বন্ধ রেখে ছড়ার সীমানা নির্ধারণ করে এরপর ফের খনন কাজ শুরু করতে ইউএনওর কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। গত ৪ মে অভিযোগটি দিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা জসীম উদ্দিন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খৈয়াছড়া ছড়াটি ‘স্মল হোল্ডার এগ্রিকালচারাল কম্পিটিটিভনেস প্রজেক্ট (এএসসিপি)’ নামে বিএডিসির তত্ত্বাবধানে খনন কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সরদার এন্টারপ্রাইজ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের পাওয়া কাজটি আগামী ৩০ জুনের মধ্যে শেষ করার কথা রয়েছে। মাসখানেক আগে কাজটি শুরু হয়েছে। কাজটি শুরু হয়েছে খৈয়াছড়া ইউনিয়নের ভূঁইয়া টিলা এলাক থেকে। সেখান থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত সংস্কার হচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের পশ্চিম পাশ থেকে পৌরসভার গোভনিয়া খাল পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার। সেখানে গিয়েই শেষ হবে এই কাজ।
সরকারি নকশা অনুযায়ী, ছড়ার জায়গা ২০ ফুট চওড়া। প্রশস্ত করার কথা ছিল ১০ মিটার বা ৩০ ফুট। গভীর হওয়ার কথা ৩ মিটার বা ৯ ফুট। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এটার তোয়াক্কা না করে খননের মাটিগুলো দিয়ে মানুষের ব্যক্তিগত জায়গায় পাড় তৈরি করতে গিয়ে ৭০ ফুট পর্যন্ত ছড়াটি প্রশস্ত করেছে। বাধা দিতে গেলে ঠিকাদারের লোকজন সরকারি কাজের দোহাই দিয়ে খনন কাজ চালিয়ে যান। ড্রেজার দিয়ে মাটি কেটে তাদের চাপা দেওয়ার হুমকি দেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
সরেজমিন গিয়ে কথা হয় খৈইয়াছড়া ইউনিয়নের পূর্ব খৈইয়াছড়া গ্রামের আনোয়ারা বেগমের সঙ্গে। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘আমার স্বামী একজন দিনমজুর। অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে এক বছর আগে ছড়ার পাশে জমি কিনে বাড়ি করি। এই বাড়িতে অনেক কষ্টে দিনযাপন করছি। আমার কোনো ছেলে নেই। ছড়াটি সংস্কার করতে গিয়ে আমার বাড়ির বেশ কিছু অংশ কেটে ফেলা হয়েছে। এখন আমি তিন মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে বিপাকে পড়েছি। ঘর থেকে বের হওয়ার পথ নেই। বৃষ্টি হলে আমার ঘরের পাড়টি ভেঙে পড়বে। সরকারের কাছে দাবি, আমাদের যেটুকু ক্ষতি হয়েছে তার যেন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।’
ইউএনও অফিসে অভিযোগ করা জসীম উদ্দিনের ভাষ্য, সরকারি নকশায় ছড়ার জায়গা ২০ ফুট চওড়া। খননের কার্যাদেশে ৩০ ফুট চওড়া ও ৯ ফুট গভীর করার নির্দেশনা রয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এক্সক্যাভেটর চালক ছড়াটি প্রায় ৭০ ফুট চওড়া করে পাড় তৈরি করছেন। এতে ক্ষতি হচ্ছে মানুষের কৃষিজমি, ছড়ার পাড়ের দরিদ্র মানুষের বসতভিটার।
আরেক ক্ষতিগ্রস্ত মঞ্জুরা বেগম বলেন, ‘আমি পাহাড়ের বাঁশ-কচু বিক্রি করে কিছু টাকা জমিয়ে ১২ বছর আগে রেললাইনের পূর্বপাশে খৈয়াছড়া এলাকায় জায়গা কিনে এখানে ঘর করেছি। আমিসহ আরও দুজন মিলে ১০ থেকে ১২ বছর ধরে বসবাস করে আসছি। আমার ঘরের এদিকে ছড়া কাটতে এলে আমি বাধা দিই। তারা বলে, জনগণের জন্য আপনাকে এ জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। এখন জায়গা ছেড়ে দিলে আমি যামু কই।’
খইয়াছড়া গ্রামের বাসিন্দা হাসিনা আক্তার বলেন, ‘প্রায় ১২ বছর আগে আমি, মঞ্জুরা বেগম ও আবুল কাশেম মিলে ১৫ শতক জমি কিনে বসবাস শুরু করি। সম্প্রতি খাল খনন করতে গিয়ে আমাদের অর্ধেক জমি কেটে ফেলেছে। ভারি বৃষ্টি হলে আমাদের বাড়িও খালের মধ্যে চলে যাবে। অর্ধশতাধিক দরিদ্র পরিবার অল্প টাকায় খালের পাড়ে জমি কিনে বাড়ি করে এখন বিপাকে পড়েছে। কোনো নোটিশ কিংবা ক্ষতিপূরণ ছাড়াই তাদের বসতভিটা, আশপাশের কৃষিজমিতে খাল খনন করছে বিএডিসি। খনন করতে গিয়ে কেটে ফেলা হচ্ছে শত শত গাছ।’
জসিম উদ্দিন নামে আরেক কৃষকের ১২ শতক জমি আছে ছড়াটির পাড়ে। এখানে ফসল আবাদ করে কোনোভাবে সংসার চালান তিনি। ওই জমির প্রায় ৩ শতক আগেই ছড়ায় বিলীন হয়েছে। নতুন খননের সময় আরও প্রায় ৪ শতক জমি কাটা পড়েছে। এ জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি জসিম।
কৃষক শাহ আলম বলেন, ‘আমার ২৯ শতক জায়গার মধ্যে প্রায় ১২ শতক জায়গা ছড়ার মাটি কেটে ভরাট করে ফেলেছে। আমি এ জমির মধ্যে চাষ করে কোনোরকম সংসার চালাচ্ছি। তারা ছড়া কাটার আগে আমাদের কোনো ধরনের নোটিশ দেয়নি। আমাদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে কোনো টাকাও দেয়নি।’
এ নিয়ে কথা হয় ইউএনও মাহফুজা জেরিনের সঙ্গে। কালবেলাকে তিনি বলেন, খাল খনন নিয়ে খৈইয়াছড়া ইউনিয়নের জসিম উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি অভিযোগ দিয়েছেন। খাল খনন নিয়ে সাধারণ মানুষ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে খেয়াল রেখে খননকাজ করতে বিএডিসির কর্মকর্তাদের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
খাল খননের সময় বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছে বলে স্বীকার করেছেন বিএডিসি চট্টগ্রাম জোনের সহকারী প্রকৌশলী তমাল দাশ। তিনি বলেন, ‘সমস্যা জানতে পেরে ঘটনাস্থলে গিয়ে সমাধানের পর খাল খনন শুরু হয়। প্রয়োজন বিবেচনায় খালগুলো খনন করা হচ্ছে। এটি শেষ হলে উপজেলার দুই লাখ মানুষ সুফল পাবে।
মন্তব্য করুন