ভাঙা পা নিয়ে ৫ আগস্টের বিজয় মিছিলে যান ফখরুল। বিজয়ের আনন্দ ঘরে রাখতে পারেনি। ওইদিন বন্দরবাজার থেকে, জিন্দাবাজার হয়ে চৌহাট্টায় জনতার মিছিলে মিশে যান তিনি। শারীরিক অক্ষমতায় বাসা থেকেও বের হতে পারেন না।
সিলেট নগরীর শেখঘাট কলাপাড়া এলাকার দিলাল মিয়া ও সেলিনা বেগম দম্পতির চার ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় সন্তান। ফখরুল সিলেট এমসি কলেজের স্নাতক ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সিলেট জেলার যুগ্ম সদস্য সচিব ও মিডিয়া সেল সম্পাদক ছিলেন ফখরুল হাসান।
গত বছরের ৪ আগস্ট বিজয়ের ঠিক আগেরদিন সিলেটে আহত হন তিনি। এখনো ঠিকমতো হাঁটতে পারছেন না। ফখরুল হাসানের আন্দোলনে অংশগ্রহণ, আহত হওয়া ও চিকিৎসার বিষয়ে কথা হয় কালবেলার সঙ্গে।
ফখরুল হাসান বলেন, আন্দোলন চলাকালে আমি সিলেট জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহসমন্বয়ক ছিলাম। ১৪ জুলাই থেকে আন্দোলনে যোগ দেই। টানা আন্দোলন চালিয়ে যাই। ৪ আগস্ট দুপুরের দিকে নগরীর বন্দর বাজার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে সেখানে ব্যারিকেড থাকার কারণে যেতে পারিনি। তখন মহাজনপট্টির দিকে যাই। সেখানে অনেকে আন্দোলনকারীরা অবস্থান নেন।
তিনি বলেন, করিমউল্লাহ মার্কেটের সামনে পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের সন্ত্রাসীরা অস্ত্র নিয়ে আমাদের ধাওয়া করে। আমরাও ইটপাটকেল ছুঁড়ি। এভাবে বেশ কিছু সময় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার পর একটা পর্যায়ে কালিঘাটের ছাত্রলীগের জনিসহ তার গ্রুপের বেশ কর্মী আমাদের পেছন দিয়ে ধাওয়া দেয়। তখন আমরা বুঝতে পারি আমাদের দুদিকে তারা ব্যারিকেড দিয়েছে, আর আমরা মাঝখানে। তখন আমরা নিরাপদ হওয়ার জন্য অন্যদিকে দৌড় দেই। দৌড় দিতেই আমার পা ভাঙা একটি কালভার্টে আটকে যায়। একজন পুলিশ এসে আমাকে ধরে বেধড়ক পেটাতে থাকে। আমি মাটিতে পড়ে যাই।
তিনি আরও বলেন, আরেকজন পুলিশ এসে বলে আর মারার দরকার নাই। তারপর জনি গ্রুপ আসছে দেখে পুলিশ আমাকে ছেড়ে দেয়। পায়ে খুব বেশি আঘাত পাই। আমি কোনোরকম দাঁড়িয়ে একটু সামনে যেতেই একজন ব্যবসায়ী দোকানের সাটার খুলে আমাকে টান মেরে দোকানের ভেতরে নিয়ে সাটার আবার বন্ধ করে দেন। দোকানের ভেতর দেখি আরও দুইতিনজন আহত অবস্থায় বসে রয়েছে।
ফখরুল বলেন, পরে বিকেল ৪টা দিকে ওই এলাকা কিছুটা শান্ত হলে আমাকে রিকশায় তুলে বাসায় যাওয়ার জন্য বলেন। আমি বাসায় যাই। রাতে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করে চটপট করতে থাকি। তখন আমার মা নাপা ট্যাবলেট খাওয়ান আর শরীরে কাপড় গরম করে স্যাক দেন। এই ব্যবসায়ীর কারণেই হয়ত আজ আমি বেঁচে আছি, না হলে জনি আমাকে চিনে, আমাকে পেলে জানেই মেরে ফেলত।
তিনি বলেন, ৪ আগস্ট রাতে বিছানায় শুয়ে ফেসবুকে দেখছিলাম, সারজিস ভাই একদফা আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন, ঢাকা চলো কর্মসূচি দেন। আর রাত ১২টা থেকে কারফিউ জারি হয়েছে। নির্ঘুম রাত কাটাই। আমি ভাবছিলাম ভোর হলেই ঢাকা যাব। আমার কাছে টাকা না থাকায় ঢাকা যেতে পারি নাই। চারদিক থেকেই লাশের খবর আসছে। পায়ের ব্যথা থেকে তখন আমার উদ্দীপনা ছিল বেশি। ভোরে একটি হ্যালমেট পরে বাসা থেকে বের হই। আমি কোনোরকম হাঁটতে পারছি। আলিয়া মাদ্রাসা মাঠের দিকে যাই।
ফখরুল বলেন, পরে সাস্টের ফয়সল ভাই ফোন দিয়ে বললেন মাজার গেটের সামনে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সেনাবাহিনী দূর থেকে ইশারা দিয়ে বলছে সামনে না যেতে। আমরা আর যাই নি। দুপুরে ঝড়বৃষ্টি শুরু হলো। ২টার দিকে দেখি চারদিক থেকে মিছিল আসছে। আর সেনাবাহিনী ব্যারিকেড তুলে নিচ্ছে। আর সবাই আনন্দে বিজয় মিছিল করছে। আমরা স্বাধীন হয়ে গেলাম। মিছিলে যোগ দিলাম। আনন্দ করলাম। সন্ধ্যার পর বাসায় গিয়ে দেখি পা ফুলে গেছে। এরপর ৬ আগস্ট ডাক্তারে যাই। ডাক্তার পরীক্ষা করে বলে পায়ের এসিএল ছিড়ে গেছে। আমি পরে এমআরআই করাই। ডাক্তার বলেন পা ঠিক হতে তিন চার মাস সময় লাগবে। সরকার থেকে ইতোমধ্যে ১ লাখ টাকার চেক পেয়েছি।
তিনি বলেন, আমরা আন্দোলনে টাকা পাওয়ার জন্য যাইনি। আন্দোলনে যারা আহত হয়েছেন দায়িত্ব নিয়ে তাদের সুচিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করার জন্য সরকারে প্রতি অনুরোধ জানাই।
মন্তব্য করুন