মহিন উদ্দিন রিপন, টঙ্গী (গাজীপুর)
প্রকাশ : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:২৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

‘আমাদের জীবন যেন থেমে আছে এই মহাসড়কে’

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক দুর্ভোগের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছবি : কালবেলা
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক দুর্ভোগের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছবি : কালবেলা

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক দেশের অন্যতম ব্যস্ততম সড়ক। প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষ এই সড়ক ব্যবহার করে রাজধানী ঢাকা ও উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করেন। বিশেষ করে টঙ্গী অংশটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, এখানে শিল্পাঞ্চল, ব্যবসা-বাণিজ্য ও ঘনবসতির কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার শ্রমিক, কর্মজীবী মানুষ ও সাধারণ যাত্রী এই সড়ক ব্যবহার করেন। অথচ এই মহাসড়ক এখন মানুষের জন্য আশীর্বাদ নয়; বরং দুর্ভোগের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এর পেছনে প্রধান কারণ হলো দীর্ঘদিন ধরে চলমান বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজের ধীরগতি, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং সাম্প্রতিক অতিবৃষ্টিতে সৃষ্ট নতুন নতুন খানাখন্দ ও গর্ত। এ তিনটি কারণে টঙ্গী থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত পুরো সড়ক এখন নিত্যদিনের দুঃসহ অভিজ্ঞতার নাম।

জানা গেছে, ২০১২ সালে অনুমোদন পাওয়া বিআরটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। লক্ষ্য ছিল গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত আধুনিক বাস সার্ভিস চালু করা, যাতে সময় সাশ্রয় হবে এবং যানজট অনেকটাই কমে আসবে। কিন্তু বছর গড়িয়েছে, প্রকল্পের সময়সীমা বারবার বাড়ানো হয়েছে, ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ, অথচ কাজ শেষ হয়নি।

সরিজমিন দেখা যায়, টঙ্গী স্টেশন রোড থেকে শুরু করে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত কোথাও খোঁড়াখুঁড়ি শেষ হয়নি, কোথাও অর্ধসমাপ্ত ব্রিজ বা ফ্লাইওভারের খুঁটি পড়ে আছে। রাস্তার মাঝখানে ফেলে রাখা ইট-পাথর, নির্মাণসামগ্রী, অসমাপ্ত ফুট ওভারব্রিজ—এসব এখন চিরচেনা দৃশ্য। ফলে যানবাহন চলাচলের রাস্তা সরু হয়ে পড়েছে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত লেগেই থাকে যানজট।

এদিকে সম্প্রতি টানা কয়েক দিনের অতিবৃষ্টিতে সড়কের নিচে মাটি দেবে গিয়ে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। কোথাও রাস্তা ভেঙে গিয়ে পানি জমে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বৃষ্টির পানিতে ঢাকা এসব গর্ত চালকদের জন্য অজানা ফাঁদে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটছে, যাত্রী আহত হচ্ছেন, যানবাহন নষ্ট হচ্ছে। অথচ এগুলো মেরামতে তেমন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

টঙ্গীর দোকান মালিক লিয়াকত শিকদার বলেন, ‘প্রায় এক যুগ ধরে দেখি রাস্তায় কাজ চলছে। খানাখন্দ কম হলেও বৃষ্টি হলেই হাঁটুপানি জমে যায়। যানবাহন তখন স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।’

টঙ্গী বাংলাদেশের অন্যতম শিল্পাঞ্চল। লক্ষাধিক শ্রমিক প্রতিদিন এই সড়ক ব্যবহার করেন। যানজট আর সড়কের খারাপ অবস্থার কারণে সময়মতো কারখানায় পৌঁছাতে না পারায় অনেক শ্রমিকের বেতন কেটে নেওয়া হচ্ছে। এক শ্রমিক প্রতিনিধি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের জীবন যেন থেমে আছে এই মহাসড়কে। কারখানায় যেতে গেলে কখনো দেরি হয়, তখন কর্তৃপক্ষ বেতন কেটে নেয়। অথচ এই দুর্ভোগের জন্য তো আমরা দায়ী নয়।’

টঙ্গী বাজার ও আশপাশের এলাকা থেকে প্রতিদিন টনকে টন পণ্য ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। কিন্তু যানজটে গাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকার কারণে পচনশীল পণ্য নষ্ট হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা ক্ষুব্ধ। একজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘ঢাকায় মাল নিতে গিয়ে পুরো দিন নষ্ট হয়ে যায়। গ্রাহকরা ক্ষুব্ধ হন, আমাদের লোকসান হয়। এভাবে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা মুশকিল।’

ভিআইপি পরিবহনের চালক মো. হাসান বলেন, ‘বিআরটি প্রকল্পের কাজের কারণে রাস্তা সরু হয়ে গেছে। অটোরিকশায় ঠাসা, ট্রাফিক পুলিশের তেমন দেখা নেই। গাজীপুর থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার যেতে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা লেগে যায়। যাত্রীদের দুর্ভোগের পাশাপাশি আমাদের জ্বালানি খরচও বেড়ে যাচ্ছে।’

টঙ্গী পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক হারুনুর রশিদ কালবেলাকে বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ যেহেতু শেষ পর্যায়ে, তাই এটি বাতিল না করে দ্রুত শেষ করা জরুরি। এখনো প্রায় ২০ শতাংশ কাজ বাকি আছে। দ্রুত শেষ করা হলে সুফল মিলবে, নইলে দুর্ভোগ আরও বাড়বে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন দেরিতে স্কুলে আসছে, দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ছে।’

সড়ক ও জনপথ (সওজ) সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটি শেষ করতে বিলম্বের পেছনে রয়েছে বরাদ্দ সংকট, প্রযুক্তিগত সমস্যা ও বর্ষাকালীন কাজে বিঘ্ন। তবু জনগণের দুর্ভোগ কমাতে অস্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শরিফুল কালবেলাকে বলেন, ‘মহাসড়কটি যেহেতু বিআরটি প্রকল্পের আওতায়, আমরা ইচ্ছে থাকলেও সরাসরি কোনো কাজ করতে পারছি না। তার পরও পানি নিষ্কাশন ও কিছু অংশ মেরামতের ব্যবস্থা করেছি।’

উল্লেখ্য, এতদিন ধরে নানা আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবে তেমন পরিবর্তন আসেনি। সাধারণ মানুষ মনে করছেন, প্রকল্পটি যেন আশীর্বাদ নয়; বরং অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানীতে ঢোকার প্রধান সড়ক যদি এমন দুরবস্থায় থাকে, তবে দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা কীভাবে বাস্তবায়িত হবে—সেই প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।

স্থানীয়রা বলছেন, উন্নয়নের নামে বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হলেও সাধারণ মানুষের জীবনে তার সুফল পৌঁছাচ্ছে না; বরং প্রতিদিন আরও দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। শ্রমিকদের সময় নষ্ট হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন, যাত্রীদের মানসিক চাপ বাড়ছে।

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী অংশ যেন দেশের অব্যবস্থাপনার প্রতিচ্ছবি। বিআরটি প্রকল্প সঠিকভাবে শেষ না হলে এই সড়ক মৃত্যুফাঁদে পরিণত হবে। জনগণের আশা, সরকার দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেবে এবং এই দুর্ভোগের অবসান ঘটাবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এই প্রথম টি-টোয়েন্টি সিরিজে মাঠে নামছে ইংল্যান্ড-আয়ারল্যান্ড

একনেকে ৮৩৩৩ কোটি টাকার ১৩ প্রকল্প অনুমোদন

ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন না হলে মাঠে নামার হুঁশিয়ারি সিপিবির

নির্বাচনে অনীহা থেকেই তাদের কর্মসূচি : আমীর খসরু

চাকসু নির্বাচনে মনোনয়ন সংগ্রহ ও জমাদানের সময় বৃদ্ধি

হ্যান্ডশেক বিতর্কে ভারতীয় খেলোয়াড়দের দোষ দেখছেন না আফ্রিদি

পরপর দুবার কামড়ালেই কুকুরের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

‘আমার লাশ চাচাতো ভাইয়ের কাছে পৌঁছে দিয়েন’ 

১০ টাকায় ইলিশ দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে বিপাকে রায়হান জামিল

স্টেশনে দোকান ভাড়ার বিষয়ে মেট্রোরেলের নতুন বার্তা

১০

তিস্তার পানি বিপৎসীমা ছুঁইছুঁই, নদীপাড়ে আতঙ্ক

১১

পূজায় কতদিনের বন্ধ পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা

১২

পাকিস্তানের দাবিতে ‘নমনীয়’ আইসিসি!

১৩

বিএনপির তরুণ নেতা আরিফুজ্জামান মামুনের জনপ্রিয়তা বাড়ছে

১৪

পপুলার ফার্মার অডিট বিভাগে চাকরির সুযোগ

১৫

আবুল খায়ের গ্রুপে বড় নিয়োগ

১৬

চিরকুট দিয়ে বৈদ্যুতিক মিটার চুরি

১৭

এসএসসি পাসেই নিয়োগ দিচ্ছে স্কয়ার গ্রুপ

১৮

সাংবাদিকদের ওপর হামলা, সাতছড়ির সেই রেঞ্জ কর্মকর্তা বরখাস্ত

১৯

সংবিধান আদেশে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ বিশেষজ্ঞদের

২০
X