জীবনে কোনো কিছুতেই কমতি নেই। সফল ক্যারিয়ার, অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য, স্বামী-সংসার সবকিছু নিয়ে নিজেকে একজন সুখী নারীই মনে করেন ডা. জাহরা। তবু প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট সময় শুরু হওয়ার আগেই তার মনে জাগে ভয়ংকর এক চিন্তা—নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চিন্তা।
ডা. জাহরার মতো এমন অনেক নারীই প্রতিমাসে ঋতুচক্র শুরু হওয়ার আগে আত্মহত্যার কথা ভাবেন। অনেকে বিষয়টাকে স্বাভাবিক বলে এড়িয়ে গেলেও এটা কোনোভাবে স্বাভাবিক নয়, বরং একটি জটিল মানসিক রোগ। এই অদ্ভুত এবং যন্ত্রণাদায়ক বাস্তবতার নাম—প্রিমেনস্ট্রুয়াল ডিসফোরিক ডিসঅর্ডার বা PMDD।
গুরুতর এই মানসিক রোগটি নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইসলামাবাদ ভিত্তিক ট্রিবিউন ম্যাগাজিন। প্রতিবেদনের মূল বিষয়গুলো কালবেলা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
পিএমডিডি কী?
পিএমডিডি (PMDD) হলো নারীদের এক প্রকার গুরুতর মানসিক এবং শারীরিক অসুস্থতা, যা মাসিক শুরুর এক থেকে দুই সপ্তাহ আগে শুরু হয়। এটি PMS বা Premenstrual Syndrome-এর চেয়ে বহুগুণ বেশি তীব্র এবং মারাত্মক। যেসব নারীরা এই রোগে ভোগেন, তাদের মানসিক অবস্থার এতটা অবনতি ঘটে যে অনেকের মাথায় আত্মহত্যার চিন্তা আসে। কারও কারও ক্ষেত্রে এই চিন্তা এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে তারা আত্মহত্যার চেষ্টা পর্যন্ত করেন।
কানাডার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. বেনিসিও ফ্রে বলেন, ‘পিএমডিডি এমন একটি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যা শুধু দুঃখবোধ বা উদ্বেগের পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে না। এতে অনেক রোগীকেই হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।’
কেন হয় এই রোগ?
পিএমডিডি’র মূল কারণ হরমোনের তারতম্যের প্রতি মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক সংবেদনশীলতা। বিশেষত, ইস্ট্রোজেনের ঘাটতি ও প্রোজেস্টেরনের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি নারীদের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। এই পরিবর্তনের ফলে সেরোটোনিন ও করটিসলের মাত্রা ওঠানামা করে, যা বিষণ্নতা, রাগ এবং হতাশা সৃষ্টি করে।
আত্মহত্যার প্রবণতা কেন তৈরি হয়?
গবেষণায় দেখা গেছে, পিএমডিডি রোগীদের আত্মহত্যা চেষ্টার ঝুঁকি সাধারণ মানুষের তুলনায় ৭ গুণ বেশি এবং আত্মহত্যার চিন্তা প্রায় ৪ গুণ বেশি হয়। তবে এই চিন্তাগুলো মাসিকের নির্দিষ্ট সময়েই হয় এবং অন্য সময়ে নারীরা স্বাভাবিক থাকেন।
ডা. ফ্রে বলেন, ‘অনেক রোগী এমন অবস্থায় থাকেন যে মাসিকের আগের ক’দিন তাদের হাসপাতালে রাখতে হয় নিরাপত্তার জন্য।’
সামাজিক সম্পর্কও ভেঙে পড়ে
পিএমডিডি নারীদের সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ককেও ভেঙে দেয়। হঠাৎ রেগে যাওয়া, চিৎকার, বিষণ্নতা বা নিঃসঙ্গতা—এসবের কারণে বন্ধুত্ব, দাম্পত্য জীবন বা কর্মক্ষেত্রে সম্পর্ক দুর্বল হয়। ‘আমি প্রতিমাসে ১০ দিনের জন্য একটা দানবে পরিণত হই। তারপর আবার ঠিক হয়ে যাই, কিন্তু নিজের ওপর ঘৃণা তৈরি হয়’, নিজের অভিজ্ঞতা এভাবেই প্রকাশ করেন এক রোগী।
চিকিৎসা কী?
গবেষকরা বলছেন, ভয়ের কিছু নেই—পিএমডিডি নিরাময়যোগ্য। প্রথম ধাপে সঠিকভাবে নির্ণয় করতে হয়। এজন্য টানা দুই মাস দৈনিক লক্ষণ লিখে রাখতে হয়। এরপর চিকিৎসকরা ডিএসএম-৫ স্কেল অনুযায়ী রোগ নির্ধারণ করেন।
প্রথম ধাপের চিকিৎসায় সাধারণত সেরোটোনিন-বেইজড এন্টিডিপ্রেসেন্ট দেওয়া হয়। এরপর হরমোন থেরাপি বা জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি। কিছু ক্ষেত্রে প্রকৃতিক ভেষজ যেমন ‘চেস্টবেরি’ কার্যকর হতে পারে। এছাড়া, কাউন্সেলিং, সিবিটি থেরাপি, ট্রমা ইনফর্মড থেরাপি ইত্যাদিও দরকারি।
কেন এ রোগ সম্পর্কে জানে না কেউ?
নারীদের মাসিক, মানসিক স্বাস্থ্য বা দেহ-সংক্রান্ত আলোচনাকে এখনো ট্যাবু মনে করা হয়। চিকিৎসা ও গবেষণার জগতে নারীদের শরীরকে অবহেলা করা হয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। সাইকোথেরাপিস্ট শিফা লোধী বলেন, ‘নারীদের শরীর জটিল মনে করে বিজ্ঞানের ইতিহাসে গবেষণা হয়নি। এ কারণে অনেক ওষুধও শুধু পুরুষদের দেহেই পরীক্ষা করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, পাকিস্তানি ও দক্ষিণ এশীয় সমাজে ‘মেয়েদের আবেগ’ মানেই ‘অস্থিরতা’—এই সংস্কার রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসাকে বাধাগ্রস্ত করে। অনেক পরিবার মানসিক চিকিৎসাকে ‘বিয়ে ভাঙার কারণ’ মনে করে, মেয়েকে নিয়ে যায় তাবিজ-কবচ ও হাকিমের কাছে।
সমাধান কী?
গবেষকরা বলছেন, পিএমডিডি নিয়ন্ত্রণে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে- # সচেতনতা বাড়ানো : স্কুলপাঠ্যে মাসিক ও মানসিক স্বাস্থ্য অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। # সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ : কর্মক্ষেত্রে পিএমডিডি বা পিএমএসবিষয়ক প্রশিক্ষণ, তথ্য ও ছুটির সুযোগ থাকা দরকার। # স্বীকৃতি দেওয়া : PMDD রোগীদের অভিজ্ঞতাকে হালকা করে দেখা যাবে না। এটা চিকিৎসাযোগ্য, বাস্তব ও ভয়ানক একটি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা।
শেষ কথা
PMDD কোনো কল্পিত রোগ নয়। এটি একটি হরমোন-নির্ভর, বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত, মানসিক ও শারীরিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়ার মতো মারাত্মক অবস্থা। প্রতি মাসে যারা এই যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যান, তারা মৃত্যুর কথা ভাবেন শুধু কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে—মরে যেতে নয়।
PMDD সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ালে শুধু রোগী নয়, পুরো সমাজই উপকৃত হবে। একজন রোগীর মতো করেই বলা যায়: ‘আমাকে বিশ্বাস করুন। এটাকে ‘সেই সময়’ বলে উড়িয়ে দেবেন না। আপনার সহানুভূতি—আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ওষুধ হতে পারে।’
মন্তব্য করুন