সবুজ চাকরি সৃষ্টি, সামাজিক সুরক্ষা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক জলবায়ু পদক্ষেপই হতে হবে ভবিষ্যতের অগ্রাধিকার। বাংলাদেশে নিম্ন-কার্বন অর্থনীতির পথে অগ্রযাত্রাকে ন্যায়সংগত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই করতে একটি জাতীয় ‘জাস্ট ট্রানজিশন’ নীতিমালা প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ, নীতিনির্ধারক, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ও তরুণ কর্মীরা।
ঢাকায় সোমবার আয়োজিত জাতীয় সংলাপে বক্তারা বলেন, জাস্ট ট্রানজিশন বা ন্যায্য রূপান্তর শুধু কার্বন নির্গমন হ্রাস বা অর্থনৈতিক পুনর্গঠন নয়, এটি মানুষের জীবন, কর্মসংস্থান, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মর্যাদার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। তাই এই রূপান্তরে শ্রমিক, তরুণ, নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে হবে, যাতে কেউ পিছিয়ে না থাকে।
‘রোড টু কপ৩০ : শেইপিং বাংলাদেশ’স জাস্ট ট্রানজিশন’ শীর্ষক এই বহুপক্ষীয় সংলাপের আয়োজন করে পরিবেশবাদী যুব সংগঠন ইয়ুথনেট গ্লোবাল ও জার্মান থিংকট্যাংক ফ্রেডরিখ এবার্ট স্টিফটুং (এফইএস)। এতে সরকার, ট্রেড ইউনিয়ন, উন্নয়ন সহযোগী, তরুণ জলবায়ু কর্মী ও গবেষকেরা অংশ নেন।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ নাভিদ শফিউল্লাহ বলেন, ‘বাংলাদেশ ইতোমধ্যে নবায়নকৃত জাতীয়ভাবে নির্ধারিত জলবায়ু অবদান (এনডিসি ৩.০)-এ জাস্ট ট্রানজিশন ধারণা সংযুক্ত করে এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এটি প্রমাণ করে, সামাজিক ন্যায়বিচার, মর্যাদাপূর্ণ কাজ এবং টেকসই উন্নয়ন একসঙ্গে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।’
সম্প্রতি এক মাঠ পরিদর্শনের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘খুলনার দাকোপ উপজেলার এক কৃষক লবণাক্ত পানিতে ফসল হারিয়ে হতাশ ছিলেন। পরে লবণ-সহনশীল ধান ও সবজি চাষ শিখে আবার আশার মুখ দেখেছেন। রাজশাহীর গোদাগারীতেও একজন কৃষক সৌরচালিত সেচ ব্যবস্থায় জমির ফসল ফিরিয়ে এনেছেন। এসবই প্রমাণ করে, উদ্ভাবন ও সহায়তা পেলে মানুষ নিজের ভাগ্য বদলাতে পারে। এটাই জাস্ট ট্রানজিশনের মূল দর্শন। ন্যায়সংগত রূপান্তর তখনই সম্ভব, যখন শ্রমিক ও কৃষকরা নতুন দক্ষতা অর্জন করবে, সবুজ কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে এবং সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।’
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)-এর অতিরিক্ত সচিব ও জাতিসংঘ উইং প্রধান একে এম সোহেল বলেন, ন্যায়সংগত জলবায়ু রূপান্তর ঘটাতে অর্থায়ন, নীতি ও সুশাসনকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশকে কপ৩০-এ জলবায়ু অর্থায়নের সুবিচারের জন্য সোচ্চার হতে হবে। বিশেষ করে নতুন ও অতিরিক্ত অনুদান, স্বল্পসুদে ঋণ এবং পূর্ববর্তী ঋণমুক্তির দাবি জোরালো করতে হবে। তিনি জানান, ইআরডি ইতোমধ্যে একটি ক্লাইমেট ফাইন্যান্স স্ট্র্যাটেজি প্রণয়ন করছে, যা জাস্ট ট্রানজিশন বাস্তবায়নে সহায়তা করবে।
ইয়ুথনেট গ্লোবালের নির্বাহী সমন্বয়ক সোহানুর রহমান মূল প্রবন্ধে বলেন, ন্যায্যতা, জবাবদিহিতা, কার্যকর নাগরিক অংশগ্রহণ ও প্রজন্মগত সমতা নিশ্চিত না হলে ন্যায়সংগত রূপান্তর সম্ভব নয়। তরুণ ও শ্রমিকদের এই প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে হবে।” তিনি জানান, ইয়ুথনেট ও এফইএস-এর যৌথ উদ্যোগে ‘ওয়াই-জাস্ট’ প্রকল্পটি তরুণ নেতৃত্বে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করছে, যার লক্ষ্য একটি ন্যায়সংগত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণ।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জার্মান দূতাবাসের প্রথম সচিব ও ডেপুটি হেড অব ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন জানিস হুসাইন এবং সুইডিশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (পরিবেশ ও জলবায়ু) ও ডেপুটি হেড অব কো-অপারেশন নায়োকা মার্টিনেজ ব্যাকস্ট্রম জলবায়ু সুবিচার আন্দোলনে তরুণদের অংশগ্রহণের প্রশংসা করেন।
জানিস হুসাইন বলেন, বাংলাদেশি তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ অনুপ্রেরণাদায়ক। তবে জাস্ট ট্রানজিশনের ফল যেন শ্রমিক সংগঠন ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
নায়োকা মার্টিনেজ ব্যাকস্ট্রম বলেন, একটি ক্রস-সেক্টোরাল পদ্ধতির মাধ্যমে এবং বাংলাদেশ ক্লাইমেট ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ (বিসিডিপি)-এর আওতায় শক্তিশালী ফোকাল পয়েন্ট গঠনের মাধ্যমে নাগরিক সমাজের কণ্ঠ আরও জোরালোভাবে শোনা সম্ভব।
প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশনস কাউন্সিলের বাংলাদেশ প্রধান ফারাহ আনজুম বলেন, ‘ন্যায়সংগত জলবায়ু রূপান্তরের পথ তৈরি করতে হলে সব পক্ষের মধ্যে বিশ্বাস ও সহযোগিতা গড়ে তোলাই হবে প্রথম পদক্ষেপ।’
বাংলাদেশ লেবার ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক একে এম আশরাফ উদ্দিন বলেন, কর্মসংস্থান নিরাপত্তা, দক্ষতা উন্নয়ন এবং তরুণদের জন্য শোভন কাজের সুযোগ তৈরি এখন সবচেয়ে জরুরি।
অক্সফামের ড. মোহাম্মদ ইমরান হাসান বলেন, নয়া জলবায়ু ঔপনিবেশিকতা, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও ন্যায্য অর্থায়নের বিষয়ে শক্তিশালী তথ্যভিত্তিক প্রচার প্রয়োজন।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের ভ্যালেন্তিনা স্পিনেদি বলেন, শিশু ও কিশোরীদের সুরক্ষা এবং সুযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে জলবায়ু বিনিয়োগকে আরও কার্যকর করা সম্ভব।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ড. শাহ আবদুল সাদী বলেন, ন্যায়সংগত রূপান্তরের জন্য দরকার একটি সার্বিক ও সমন্বিত সরকারি পদক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নের আন্তরিকতা।
সমাপনী পর্বে এফইএস বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি ড. ফেলিক্স গার্ডেস বলেন, সরকার, তরুণ, শ্রমিক সংগঠন ও উন্নয়ন সহযোগীরা একসঙ্গে কাজ করলেই বাংলাদেশের জাস্ট ট্রানজিশন ভিশন বাস্তবায়িত হবে।
জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ৩০ অনুষ্ঠিত হবে ২০২৫ সালের ১০ থেকে ২১ নভেম্বর ব্রাজিলের বেলেম শহরে। এই সম্মেলনে বিশ্বনেতারা, বিশেষজ্ঞ ও কর্মীরা একত্রিত হবেন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ন্যায়সংগত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই সমাধান খুঁজে বের করতে। এই সম্মেলনের অন্যতম মূল আলোচ্য বিষয় হবে জাস্ট ট্রানজিশন বা ন্যায্য রূপান্তর অর্থাৎ এমন এক জলবায়ু রূপান্তর প্রক্রিয়া, যা জলবায়ু কর্মপরিকল্পনার পাশাপাশি শ্রমিক, নারী, যুব ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায্যতাকে অগ্রাধিকার দেবে।
মন্তব্য করুন