টাকা রোজগার করা কঠিন কাজ। স্বাভাবিকভাবে টাকা আয় করা আরও কঠিন। টাকা জমানো সে তো স্বপ্নের মতো। দেশের বর্তমান বাস্তবতায় সৎভাবে কাজ করে সারা জীবনেও একটা ছোট ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব নয়। তার ওপর এখন রয়েছে চাকরির নিরাপত্তার প্রশ্ন।
টাকা আয় করা এবং জমানো উভয়েই এখন কঠিন কাজ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের কিছু লোকের জন্য টাকা ‘বানানো’ আদৌ কোনো কঠিন কিছু নয়। হর-হামেশাই লোকে টাকা ‘বানিয়ে’ ফেলছেন। ভাগ্য এমনিতেই তৈরি করা যায় না। ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, খরা, পণ্যের অভাব, পরিবহন সংকট, ডলার সংকট, সাপ্লাই চেইন বিপর্যয় ইত্যাদির মতো ঘটনার দরকার হয়।
দরকার হয় উৎসবের অজুহাত, চাহিদা বৃদ্ধির অজুহাত। দরকার হয় বাজেটে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত—লাগে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত। কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে যদি সরকারি নীতি সহায়তা পাওয়া যায় অথবা সরকারি নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ পাওয়া যায়, তাহলে পোয়াবারো। বানাও টাকা।
নীতি যদি হয় কিছু লোককে টাকা বানাতে সাহায্য করা, নীতি যদি হয় পুঁজি গঠনে এর দরকার আছে—তাহলে কথাই নেই। মনে হয় এমনই একটা অবস্থা এখন বিদ্যমান। এ কথা বলছি, পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি ও এর মূল্যহ্রাসের ঘটনা দেখে। দেশে এমন কী ঘটল, ভরা মৌসুমে পেঁয়াজের মূল্য হঠাৎ ১০০ টাকা কেজিতে উঠে গেল! ৪০, ৫০, ৬০ টাকা করতে করতে একবারে ৯০/১০০ টাকা কেজিতে পেঁয়াজের দাম! মানুষ হতবাক।
সরকারের প্রভাবশালী মহল বলল—কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে। তারা উপকৃত হচ্ছে। বারবার তারা ঠকে, এবার তারা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে। এটা ভালো খবর। কিন্তু কেউ এ প্রশ্ন করল না, এই সময়ে কৃষকের হাতে উৎপাদিত পেঁয়াজের কতটা আছে? উৎপাদকদের কাছে কত পেঁয়াজ আছে?
আমাদের কৃষকদের ফসল ধরে রাখার ক্ষমতা কম। অনেক ক্ষেত্রে নেই-ই। অতএব মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ নিয়েছে মুনাফাখোর কিছু ব্যবসায়ী। তারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজার লুট করছে। সাধারণ মানুষের পকেট কাটছে। তারা বলছে পেঁয়াজের চাহিদা বেশি, সরবরাহ কম। আসলে প্রকৃত অবস্থা কী?
খবরের কাগজে দেখলাম পেঁয়াজ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন সপ্তম সারা বিশ্বে। শুধু পেঁয়াজ নয়, আলু, আদা, বেগুন, শিমের বিচি, নারকেলের ছোবড়া ইত্যাদি উৎপাদনে আমরা সারা বিশ্বের মধ্যে সপ্তম অবস্থানে। আগে পেঁয়াজ আমদানি করতে হতো অনেক বেশি। এখন তা নেমেছে পাঁচ-সাত লাখ টনের নিচে। তাও সারা বছরে। তা লাগে মাসে মাসে, একবারে লাগে না। যেখানে আমরা পেঁয়াজের উৎপাদন দিন দিন বাড়াচ্ছি, সরকার এসব পণ্য উৎপাদনে নানা সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে হঠাৎ করে কী কারণে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৫০/৬০/৭০ টাকা বাড়ল?
এখন তো অস্বাভাবিক কোনো অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। হঠাৎ করে চাহিদার পরিমাণও বাড়েনি। কেউ আমাদের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। তাহলে কেন এই দাম বৃদ্ধি?
বাণিজ্যমন্ত্রী বললেন, পেঁয়াজ নিয়ে কী হচ্ছে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে? কৃষিমন্ত্রী মূল্য বৃদ্ধিকে সমর্থন করলেন। এই হযবরল—অবস্থা কেন? পেঁয়াজের অভাব তাই মূল্যবৃদ্ধি, এটা যে কত বড় খোঁড়া যুক্তি তা প্রমাণিত হলো সরকারের একটা ঘোষণায়। সরকার যেই ঘোষণা দিল, পেঁয়াজ আমদানি করা হবে তখনই দাম কমতে শুরু করল। ভারত থেকে আমদানি শুরু হলো, ব্যাস মূল্যহ্রাস একদিনেই হয়ে গেল। এক দিন দুই দিনেই এই কাণ্ড!
মূল্যস্ফীতি নয়, রাজস্ব নীতি নয়, বাণিজ্য নীতিতেই বাজার ঠিক হয়ে গেল! পেঁয়াজ আমদানিকারক, আড়তদার পাইকার এবং খুচরা বিক্রেতা এক দিনেই শিক্ষা নিলেন! দাম কমাতে বাধ্য হলেন। অথচ কৃষি মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাড়াবাড়িতে দেশবাসীর পকেট খালি হলো। মানুষ দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাল। সময় মতো আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে কেন দেরি করা হলো? কেন মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলানো হলো?
কারা এর জন্য দায়ী? এর কোনো উত্তর কোনোদিন মিলবে না। অথচ এই ফাঁকে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী শত শত কোটি টাকা বাজার থেকে লুটে নিলেন। নিলেন মুনাফার নামে যা পুঁজিবাদে অননুমোদিত। একে সাধারণভাবে অর্থনৈতিক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এসব অবৈধ লাভের ওপর কোনো অতিরিক্ত করের ব্যবস্থা নেই। নেই শাস্তিমূলক কর অথবা অন্য প্রশাসনিক শাস্তি। এ যেন কিছু লোকের হাতে টাকা যাক, কিছু লোক টাকা তৈরি করুক তার একটা স্বঘোষিত নীতি।
এই ধরনের অঘোষিত নীতির মাধ্যমে দেশে এক শ্রেণির লোক সমানে টাকা বাগিয়ে চলেছে। এর মানে এই বাণিজ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা সাধন ও পরিশ্রমের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা স্রেফ সরকারি নীতি সহায়তা ও নিষ্ক্রিয়তার ফল। তাই নয় কি?
বলাবাহুল্য এই অবস্থায় টাকা বানানো কোনো ঘটনাই নয়। ‘অ্যাক্সেস টু পাওয়ার’ থাকলেই তা করা যায়। এটা থাকলে ধরাকে সরা মনে করা যায়। এর প্রমাণ আরও আছে।
বোঝা যাচ্ছে নীতি সহায়তার সুযোগ নিয়ে, নীতি নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে প্রায় সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের বাজারে বিশাল সিন্ডিকেটের জন্ম হয়েছে। চাল, ডাল, সয়াবিন, খেজুর, পেঁয়াজ, রসুন, আদা—ফল থেকে শুরু করে প্রায় সব ভোগ্যপণ্যের সিন্ডিকেট আছে দেশে। এর অংশীদার বড় বড় আমদানিকারক, পাইকার—সবাই। বড় বড় ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীরা পণ্যভিত্তিক সিন্ডিকেট তৈরি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। পণ্যের মূল্য বাড়াচ্ছে। বাড়ানোর সময় বলছে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির কারণে তা হচ্ছে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে যখন দাম কমছে তখন উল্টো যুক্তি দিয়ে বলে তারা লোকসানে পড়ছে। না হয় ব্যাংকঋণের টাকা ফেরত দিতে পারছেন না ইত্যাদি।
তারা নিজেদের বিশাল বিশাল জাহাজে পণ্য আমদানি করে। বস্তুত আমদানিকৃত পণ্যবোঝাই জাহাজের বহিঃনোঙর থাকে চট্টগ্রামে। ইজারাতে মাল উঠানামা করে। তারা আমদানি শুল্ক, ভ্যাট ও কর ইত্যাদি ম্যানিপুলেট করে। তারাই বড় বড় পোশাকশিল্পের মালিক। বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক। তারাই সংসদ সদস্য। রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা সবই তাদের দখলে। তারাই ঋণ খেলাপি, তারাই ভালো ঋণ গ্রহীতা। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এসব জানে। খাদ্যমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রী, বস্ত্রমন্ত্রীসহ অন্যান্য বাণিজ্যবিষয়ক উপদেষ্টা—তারা সব বড় বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি। তাদের নখ দর্পণে সব। তারা জানে কীভাবে সিন্ডিকেট কাজ করে। মন্ত্রীরাও সিন্ডিকেটের কথা বলছেন। অনেক ক্ষেত্রে তারাও অসহায়। এসব কথা মন্ত্রীদের কথাতেও ফুটে উঠেছে। এই সিন্ডিকেটের কারণে মূল্যস্ফীতি কোনোভাবে কমানো যাচ্ছে না।
বর্তমান মূল্যস্ফীতি যতটুকু না আমদানিবাহিত বা আমদানি থেকে জাত, তার চেয়েও বেশি সিন্ডিকেটের কার্যক্রমে। তারা এত শক্তিশালী যে তাদের বন্ধু বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মন্ত্রীদের পর্যন্ত ধোঁকা দেয়। প্রশাসন তাদের সামনে কিছুই নয়। এমতাবস্থায় শুধু মুদ্রানীতি এবং রাজস্ব নীতি দিয়ে বর্তমান মূল্যস্ফীতি ঠেকানোর ব্যবস্থা হবে না। এর প্রমাণ সর্বশেষ মূল্যস্ফীতির হার। পরিকল্পনামন্ত্রী একবার আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছিলেন মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে কমতে থাকবে। কিন্তু গত মে মাসে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ১০ শতাংশে পৌঁছেছে। আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি। প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত অস্বস্তির কথা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, মানুষ কষ্টে আছে। যে কোনো মূল্যে মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। আমি আগেই বলেছি শুধু মুদ্রানীতি এবং রাজস্ব নীতি নিয়ে মূল্যস্ফীতি রোধ করা যাবে না। যেমন এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় সব পণ্যের মূল্য হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বাজারে তার কোনো আঁচ পড়েনি। এর কারণ কী? তা খতিয়ে দেখা একান্ত প্রয়োজন।
শুরু করেছিলাম টাকা বানানোর কথা দিয়ে। পেঁয়াজের মূল্য নিয়ে। আমরা দেখলাম পেঁয়াজের উৎপাদন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও এর দাম অভ্যন্তরীণ বাজারে কারসাজির কারণে কমছে না। একশ্রেণির ব্যবসায়ী ইচ্ছামতো এর দাম বাড়াচ্ছে-কমাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শুধু পেঁয়াজের নয়, আরও অনেক পণ্য রয়েছে। ১০ জুনের পত্রিকাতে খবর রয়েছে, বাংলাদেশ ২০০১ সালে ১১টি ফসল উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ দশের মধ্যে ছিল। ২০১১ সালে তা উন্নীত হয়ে ১৭টি হয়েছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশ ২২টি পণ্যের উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে একটি। অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। শুধু এসব পণ্য নয়, মাছ, মাংস, তরি-তরকারি, দুধ ইত্যাদি উৎপাদনেও আমাদের সাফল্য অসামান্য। সরকারের নীতি সহায়তায় এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। ভর্তুকি নীতি, ঋণনীতি, বিপণন নীতি ইত্যাদি কারণে আমাদের পরিশ্রমী কৃষকরা এই অবদান রেখে চলেছেন। কিন্তু এখানে মুশকিল দুটো।
কৃষকরা উৎপাদন বাড়াচ্ছেন ঠিকই কিন্তু তারা ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। আমরা ১৯৬৪-৬৫ সালে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখনো আলোচনার বিষয় ছিল পণ্যের ন্যায্যমূল্য। কীভাবে কৃষকদের ন্যায্যমূল্য দেওয়া যায় তার ওপর ‘টিউটোরিয়াল’ লিখে স্যারদের কাছে জমা দিয়েছি। ডিগ্রি নিয়েছি। তারপর মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা। স্বাধীনতার পর বায়ান্ন বছর যায় যায়। এখনো সেই পুরোনো কথা আমরা বলেই চলেছি। কত সরকার আসছে আবার যাচ্ছে। কৃষকের সন্তান বিসিএস দিয়ে দেশ চালাচ্ছে। কিন্তু কৃষকের অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। বরং অবস্থা অনেক ক্ষেত্রে খারাপ হয়েছে।
মেনে নিলাম, ঠিক আছে কৃষকের অবস্থা খারাপ, তারা ন্যায্যমূল্য পান না। তাহলে ভোক্তারা কী ন্যায্যমূল্যে জিনিসপত্র পাচ্ছে? না, তাও পাচ্ছে না। সুপারি, শুকনা মরিচ, চাল, রসুন ও অন্যান্য শ্রেণিভুক্ত চিনি জাতীয় ফসল এবং চাল, জামের মতো ফল, সুগন্ধি চাল, মসুর ডাল, পেঁয়াজ, আলু, আদা, বেগুন, চা, কুমড়া, আম, সবজি ইত্যাদি জাতীয় পণ্যের উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের শীর্ষ দশে। কিন্তু এর ফল কি আমরা পাচ্ছি? ভোক্তারা কি ন্যায্যমূল্যে এসব পণ্য পাচ্ছে? নিশ্চয়ই নয়। তাহলে কী দাঁড়াল? কৃষকরা উৎপাদন করছে তারা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। ভোক্তারা ন্যায্যমূল্যে কৃষি পণ্য পাচ্ছে না। অন্যান্য দ্রব্য যেসব উৎপাদনে আমাদের রেকর্ড ঈর্ষণীয়। এসবের উল্লেখ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে রয়েছে। উৎপাদন বৃদ্ধি, সরকারি সহায়তায় ফসল বৃদ্ধির ফল তাহলে কারা ভোগ করছে। নিশ্চিতভাবেই এর সুফল ভোগ করছে মধ্যস্বত্তভোগী ব্যবসায়ীরা, এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা যারা মুনাফা ছাড়া কিছুই বোঝে না। ভোগ করছে সিন্ডিকেটওয়ালারা, পণ্যভিত্তিক সিন্ডিকেটওয়ালারা। তাহলে উপায় কী? এর উত্তর আমাদের জানা নেই।
ড. আর এম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক
মন্তব্য করুন