আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুলিশ সদস্যদের নির্বাচনী প্রশিক্ষণের প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে ২০২৪ সালের আওয়ামী লীগের দলীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ভাই কাজী জিয়াউদ্দিনকে নিয়োগে করা নিয়ে পুলিশের মধ্যেই চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। কাজী হাবিবুল আউয়ালের আপন ভাই যখন আগামী নির্বাচনে প্রশিক্ষণের সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত মডেল নির্বাচনের স্বপ্নের যবনিকাপাত হতে যাচ্ছে বলে অনেকেই মনে করছেন।
শুধু তাই নয়, গত ১৬ বছরের গোপালগঞ্জ বলয়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রিত সিন্ডিকেটের আইনি পরামর্শদাতা হিসেবে পরিচিত পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমান আল মামুন এই নির্বাচনে প্রশিক্ষণের মডিউল এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে সার্বক্ষণিক সাচিবিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত। এতে পুরো প্রশিক্ষণ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের গোপন এজেন্ডা হিসাবে পরিগণিত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ পুলিশের এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর কর্মসূচিতে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের ভাই কাজী জিয়াউদ্দিন এবং আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলে শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের আইনি উপদেষ্টা হিসেবে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমান আল মামুনকে সম্পৃক্ত করার বিষয়ে বর্তমানের পুলিশ কর্মকর্তাদের দুর্বলতা এবং দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
জানা যায়, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বের কাছে স্বপ্নের মডেল নির্বাচন উপহার দেওয়ার অঙ্গীকারের ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের জন্য বাংলাদেশ পুলিশকে উপযোগী করার অংশ হিসেবে আনুমানিক দেড় লাখ পুলিশ সদস্যকে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি আগামী ৭ সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশ পুলিশ অডিটরিয়াম রাজারবাগে শুরু হবে। এতে সব জেলার পুলিশ সুপার, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, সব রেঞ্জ ডিআইজি, মেট্রোপলিটনের উপ-পুলিশ কমিশনারসহ আনুমানিক ১৫০ জনকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। পুলিশের আইজি এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দিকনির্দেশনা মূলক বক্তব্য দেবেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন রেঞ্জ ও জেলায় ধাপে ধাপে সবাইকে আগামী নির্বাচনের আগেই এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় ট্রেনিং করার কর্মসূচি নির্ধারিত হয়েছে।
প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য হিসেবে আগামী নির্বাচন মডেল নির্বাচন হিসেবে পুলিশের সদস্যরা গত তিনটি নির্বাচনের তিক্ত কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদেরকে দূরে রেখে সঠিকভাবে নিজেদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে হাতে কলমে প্রশিক্ষিত হয়ে প্রধান উপদেষ্টার স্বপ্নের মডেল নির্বাচনে ভূমিকা রাখা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ২০২৪ সালের আওয়ামী দলীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ভাই কাজী জিয়াউদ্দিন এবং গোপালগঞ্জভিত্তিক গত ১৬ বছরের আওয়ামী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিশ্বস্ত এবং আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের একাধিকবার আইন সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান আল মামুকে এই প্রশিক্ষণের সমন্বয়ক ও সাচিবিক দায়িত্ব পালন করার বিষয় নিয়ে পুলিশের বর্তমান কর্তা ব্যক্তিদের অদক্ষতা যেমন সামনে এসেছে তেমনি স্বপ্নের নির্বাচনে প্রশিক্ষণে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়ন হচ্ছে বলেই প্রতীয়মাণ হচ্ছে।
আরো জানা যায়, কাজি জিয়াউদ্দিন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে আওয়ামী লীগের দলীয় আইজিপি হিসেবে বিবেচিত হাসান মাহমুদ খন্দকারের পিএস হিসাবে পুলিশ সদর দপ্তরে কর্মরত ছিলেন। তিনি গত ২০ বছরে আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মী হিসেবে পরিচিত সাবেক আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকারের পিএস, সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সাবেক আইজিপি এ কে এম শহিদুল হকের সময়ে পুলিশ সদর দপ্তর ও পুলিশ টেলিকমে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে, ২০১৮ সালের রাতের ভোটের কারিগর ডক্টর জাবেদ পাটোয়ারীর সময়ে পুলিশ সদর দপ্তরে অপারেশন শাখার দায়িত্ব থেকে নির্বাচনী মেকানিজম সমন্বয়, শাপলা উত্তর গণহত্যার সমন্বয়ক সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদের সময়ে পুলিশের আওয়ামী লীগ দলীয় কর্মী নিয়োগে হিউম্যান রিসোর্স শাখার দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা ছিলেন। কাকতালীয়ভাবে তিনিই ৫ আগস্ট ২০২৪ পরবর্তী আইজিপিদের গুডবুকে থাকার সৌভাগ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। এই কর্মকর্তা এখনো পুলিশের নিয়োগ শাখার ডিআইজি হিসেবে নিজেকে এন্টি ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তা বলে দাবি করছেন।
পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি মতে, কাজী হাবিবুল আউয়ালের ভাই হিসাবে তৎকালীন সময়ে তিনি সার্বক্ষণিক পুলিশ সদর দপ্তরের সাথে নির্বাচনী গোপন এজেন্ডা সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করতেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনকালীন পুলিশ কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়ন প্রস্তাব পুলিশ সদর দপ্তরের বার্তা নিয়ে প্রায়শ: কমিশনে যাতায়াত করতে বলে প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। কাজী হাবিবুল আউয়ালকে ‘অপু’ ভাই হিসেবে পারিবারিক নামেই কাজী জিয়াউদ্দিন কথা বলতেন বলে তখনকার সময়ের কর্মকর্তারা জানান।
শুধু তাই নয়, গত ১৬ বছরে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা বাংলাদেশ পুলিশের পুলিশ সপ্তাহসহ সব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের খসড়া বক্তব্য লেখনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন কাজি জিয়াউদ্দিন। বাংলাদেশ পুলিশের বিপিএম পদক প্রাপ্তির সময় কাল সর্বশেষ আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন যিনি ২০২৪ গণঅভ্যুত্থানের সময়ে নির্বিচারে ছাত্র-জনতা হত্যার দায়ে গ্রেপ্তার হয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাজসাক্ষী হিসেবে বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছেন।
অপরদিকে, এই গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল প্রশিক্ষণ কর্মসূচির সাচিবিক কাজে নিয়োজিত পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমান আল মামুন গত ১৬ বছরে সাবেক আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকারের প্রত্যক্ষ নির্দেশে পুলিশ সদর দপ্তরে পদায়িত হয়ে তৎকালীন পুলিশ সিন্ডিকেট আতিকুল ইসলাম, হাসানুল হায়দার, আবু হাসান তারিকুল ইসলাম, প্রলয় কুমার জোয়ারদার গঙদের বিশ্বস্ত সাচিবিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে নিজেকে আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে পরিগণিত করেছেন। গোপালগঞ্জ ও বিশ্বস্ত আওয়ামী লীগের কমিটি হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশনের একাধিকবার আইন সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন, ২৫তম বিসিএস পুলিশ ব্যাচের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন, ফেসবুক আইডিতে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের গুণ কীর্তন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক আইন বিভাগের ছাত্রদের সংগঠন-যার প্রধান নির্বাহী হিসাবে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি কাওসার মোল্লার সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন, আওয়ামী লীগের দলীয় ক্যাডারদের পরিচালিত তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ্যালামনাই এসোসিয়েশনের কার্যকরী কমিটির কাওসার মোল্লা সভাপতিত্বে দখলকৃত গ্রুপের কার্যনির্বাহী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন, সাবেক আইজিপি এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশীর্বাদে ২০২৩ সালের টাল-মাটাল রাজনৈতিক সংকটকালে মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার হিসেবে পদায়িত হয়ে বিএনপি কর্মী হত্যার দায় সামাল দিতে না পেরে প্রত্যাহার হওয়ার মতো কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন।
শুধু তাই নয়- এই কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের ১৬ বছরে দুবার পুলিশ পদকে ভূষিত হয়েছেন-যা পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে বিস্ময়কর হিসেবে বিবেচিত আছে। ৫ আগস্ট ২০২৪ পরবর্তী সময়ে এই কর্মকর্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক আইন বিভাগের উপদেষ্টার হাত ধরে পুলিশ সদর দপ্তরে গুরুত্বপূর্ণ শাখায় কর্মরত আছেন।
আরও জানা যায়, বাংলাদেশ পুলিশের নতুন পদ সৃষ্টি এবং নিয়োগ পদ্ধতিতে বিরোধী দলমতকে বাইরে রেখে আওয়ামী দলীয় কর্মীদেরকে নিয়োগ সংক্রান্তে পরীক্ষা চলাকালীন প্রার্থীদের রাজনৈতিক পরিচয় বের করে কৌশলে বাদ দেওয়ার কৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রে গত ১৬ বছরে সিন্ডিকেটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে এই কর্মকর্তার ভূমিকা সকল পুলিশ সদস্যদের কাছে স্পষ্ট। শুধু তাই নয়, শেখ হাসিনা সরকারের সময় গোপালগঞ্জকেন্দ্রিক সব কর্মকর্তাদের বাসা ও অফিসে নিয়মিত যাতায়াতের এত নজির খুব কম কর্মকর্তাদের আছে।
দীর্ঘদিন বঞ্চিত একাধিক পুলিশ কর্মকর্তাদের মতে, প্রধান উপদেষ্টার আগামী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির স্বপ্নের মডেল নির্বাচনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী বাংলাদেশ পুলিশের ১ লাখ ৫০ হাজার সদস্যের নির্বাচনী প্রশিক্ষণে এ ধরনের আওয়ামী লীগের সুবিধাবাদী ও বিশ্বস্ত কর্মকর্তাদের সমন্বয়ক ও সাচিবিক কাজে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে পুরা বিষয়টি বিশেষ কোনো চক্রান্তের ফাঁদে পড়েছে কি না এই বিষয়টি মন্ত্রণালয়সহ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সরাসরি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তদন্ত আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) কাজী জিয়া উদ্দিন বলেন, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করতে আমরা দেড় লাখ বা তারও বেশি পুলিশ সদস্যকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের প্রশিক্ষণ দেব।’
মন্তব্য করুন