জাতিসংঘ (United Nations) বিশ্বের জাতিগুলোর একটি সংগঠন; যার লক্ষ্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইন, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক অগ্রগতি এবং মানবাধিকার বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করা।
১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর ৫১টি রাষ্ট্র জাতিসংঘ সনদ সইয়ের মাধ্যমে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং পরে বিলুপ্ত লীগ অব নেশন্সের স্থলাভিষিক্ত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে বিজয়ী মিত্রশক্তিরা যেন পরে যুদ্ধ ও সংঘাত প্রতিরোধ করতে পারে—এই উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়। তখনকার বিশ্ব রাজনীতির পরিস্থিতি জাতিসংঘের সাংগঠনিক কাঠামোতে এখনও প্রতিফলিত হচ্ছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য (যাদের ভেটো প্রদানের ক্ষমতা আছে) হলো—যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও গণচীন। এরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী দেশ।
২০১৬ সালের তথ্যানুসারে, জাতিসংঘের সদস্য সংখ্যা ১৯৩টি। বিশ্বের প্রায় সব স্বীকৃত রাষ্ট্রই এর সদস্য। তবে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম হলো তাইওয়ান, ভ্যাটিকান সিটি। এ ছাড়া অন্যান্য কিছু অস্বীকৃত এলাকার মধ্যে রয়েছে ট্রান্সনিস্ট্রিয়া ও উত্তর সাইপ্রাসের তুর্কি প্রজাতন্ত্র। জাতিসংঘে যোগ দেওয়া সর্বশেষ সদস্য রাষ্ট্র দক্ষিণ সুদান।
জাতিসংঘের সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে অবস্থিত। এটি ১৬ একর জমিতে ১৯৪৯ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে নির্মাণ করা হয়। ভবনটি ইস্ট নদীর তীরে অবস্থিত। সদর দপ্তর স্থাপনের জমি কেনার জন্য জন ডি রকফেলার জুনিয়র ৮ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেন। তিনি জাতিসংঘকে এই জমি দান করেন। সদর দপ্তরের মূল ভবনটির নকশা প্রণয়ন করেন লে করবুসিয়ে, অস্কার নিয়েমেয়ারসহ আরও অনেক খ্যাতনামা স্থপতি। নেলসন রকফেলারের উপদেষ্টা ওয়ালেস কে হ্যারিসন এই স্থপতি দলের নেতৃত্ব দেন। আনুষ্ঠানিকভাবে সদর দপ্তরের উদ্বোধন হয় ১৯৫১ সালের ৯ জানুয়ারি।
সদর দপ্তর নিউইয়র্কে হলেও জাতিসংঘের বেশ কিছু অঙ্গসংগঠনের প্রধান কার্যালয় সুইজারল্যান্ডের জেনেভা, নেদারল্যান্ডের দ্য হেগ, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা, কানাডার মন্ট্রিল, ডেনমার্কের কোপেনহাগেন, জার্মানির বন ও অন্যত্র অবস্থিত। জাতিসংঘের সদর দপ্তরের পুরোনো ভবনের সংস্কার কাজ উপলক্ষে ম্যানহাটানের ফার্স্ট অ্যাভিনিউতে ফুমিহিকো মাকির নকশায় অস্থায়ী দপ্তর নির্মাণ করা হচ্ছে। ১৯৪৯ সালের আগে পর্যন্ত লন্ডন ও নিউইয়র্কের বিভিন্ন স্থানে জাতিসংঘের কার্যালয়ের অবস্থান ছিল।
বিশ্বের যে কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র জাতিসংঘের সদস্য হতে পারে। জাতিসংঘ কিছু মহৎ উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে গঠিত হয়েছে। জাতিসংঘ গঠনের পাঁচটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো—বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা; বিভিন্ন জাতি তথা দেশের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন করা; অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের মধ্যে সহযোগিতা গড়ে তোলা; জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের প্রতি সম্মান গড়ে তোলা; বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিদ্যমান বিবাদ মীমাংসা করা।
জাতিসংঘের ছয়টি দাপ্তরিক ভাষা হলো—আরবি, চীনা, ইংরেজি, ফরাসি, রুশ এবং স্পেনীয় ভাষা। জাতিসংঘের সচিবালয়ে যে দুটি ভাষা ব্যবহৃত হয় তা হলো ইংরেজি ও ফরাসি। জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষাগুলোর মধ্যে ইংরেজি ৫৪টি সদস্য দেশের সরকারি ভাষা। ফরাসি হলো ২৯টি দেশের, আরবি ২৪টি দেশের, স্পেনীয় ২১টি দেশের, রুশ ১০টি দেশের এবং চীনা ভাষা চারটি দেশের সরকারি ভাষা। এ ছাড়া জাতিসংঘে কিছু প্রস্তাবিত দাপ্তরিক ভাষা হলো—বাংলা, হিন্দি, জার্মান, পর্তুগিজ, মালয়, তুর্কি, জাপানি, সোয়াহিলি ইত্যাদি।
সাংগঠনিকভাবে জাতিসংঘের প্রধান অঙ্গ সংস্থাগুলো হলো—সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ, সচিবালয়, ট্রাস্টিশিপ কাউন্সিল এবং আন্তর্জাতিক আদালত। আরও রয়েছে—বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনেস্কো, ইউনিসেফ ইত্যাদি।
জাতিসংঘের প্রধান নির্বাহী হলেন এর মহাসচিব। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে মহাসচিব পদে রয়েছেন পর্তুগালের নাগরিক রাজনীতিবিদ ও জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।
মন্তব্য করুন