‘যুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন সত্য প্রথম নিহত হয়।’—এই প্রবাদবাক্য যেন হুবহু মিলে যায় ভারত ও পাকিস্তানের চলমান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে। সীমান্তে গোলাগুলি, জঙ্গি হামলা, বিমান অভিযান আর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় দুই দেশের জনমনে জেগে উঠেছে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও প্রতিশোধের মনোভাব।
কিন্তু এই আবেগের উত্তাপে যে চেহারাটি আড়ালে পড়ে যায়, তা হলো সাধারণ মানুষের দুর্দশা এবং ক্ষমতাকেন্দ্রের কৌশলী হিসাব।
যখন রাষ্ট্রগুলো যুদ্ধ বা সশস্ত্র সংঘাতের পথ ধরে, তখন জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলো পেছনে পড়ে যায়। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, জ্বালানি—এসব মৌলিক খাতে বরাদ্দ কমে গিয়ে বেড়ে যায় সামরিক বাজেট।
দুই দেশের সরকার ও রাজনীতিকরা যুদ্ধাবস্থার আবহ ব্যবহার করে নিজেদের ব্যর্থতা ঢেকে ফেলেন। ফলত, অদৃশ্য এক চক্র—রাজনীতিবিদ, সামরিক শক্তি, আন্তর্জাতিক অস্ত্র কোম্পানি ও কর্পোরেট মিডিয়া—এই উত্তেজনা থেকে লাভবান হয়।
যুদ্ধ প্রস্তুতির নামে কোটি কোটি ডলারের অস্ত্র চুক্তি হয়, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, আর রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের “দেশরক্ষার প্রতীক” হিসেবে তুলে ধরে জনসমর্থন বাড়িয়ে তোলে।
প্রথমে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বর্তমানে সংকটাপন্ন। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন ছিল নজিরবিহীন সেনা হস্তক্ষেপ ও কারচুপির উদাহরণ। ইমরান খান কারাবন্দি, তার দলের প্রতীক বাতিল, সমর্থকদের দমন-পীড়ন সত্ত্বেও জনসমর্থন রুখে রাখা যায়নি। সেনাসমর্থিত জোট সরকার ক্ষমতায় বসলেও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অনিশ্চিত।
পাকিস্তানের সেনা নিয়ে দেশটির এক বিচারপতি বলেছিলেন ‘বিশ্বের সেনাবাহিনী যেখানে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সেখানে জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ক্ষমতা ধরে রাখে।’
এদিকে অর্থনীতিতেও দেশটি হিমশিম খাচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক ঋণের চাপ, বেকারত্ব, বেলুচিস্তান বিদ্রোহ, আফগান সীমান্ত সমস্যা ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা একসঙ্গে পাকিস্তানকে আঘাত করছে। চীনের সঙ্গে অংশীদারিত্বে থাকা বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পও নিরাপত্তাজনিত কারণে বাধাগ্রস্ত।
এই প্রেক্ষাপটে সীমান্ত উত্তেজনা সৃষ্টি করে ক্ষয়ের পথে থাকা সেনাবাহিনী ও ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী নিজেদের কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।
অপরদিকে ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে পুলওয়ামা হামলা এবং বালাকোট বিমান হামলা বিজেপির পক্ষে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। নিহত সেনাদের ছবি দিয়ে প্রচার চালিয়ে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ধর্মীয় রক্ষকের জোয়ার তুলে বিজেপি বিপুল ভোটে জেতে। অথচ ২০২৫ সালে এসেও হামলার নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি, গোয়েন্দা গাফিলতির দায় কেউ নেয়নি।
২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে জোট সরকার গঠন করেছে। ঠিক এরপরেই কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর জঙ্গি হামলায় ২৬ জন নিহত হন। তখনও প্রশ্ন ওঠে—এত সেনা ও নজরদারির মধ্যেও হামলাটি কীভাবে সম্ভব হলো?
এই ঘটনার পর পুরনো চিত্রই আবার ফুটে ওঠে: পাকিস্তানকে দায়ী করে প্রতিশোধের হুঙ্কার, সীমান্তে বিমান হামলা, আর গণমাধ্যমে যুদ্ধোন্মাদ প্রচার। অথচ আক্রমণের আগে গোয়েন্দা সতর্কতা উপেক্ষা, নিরাপত্তার ফাঁকফোকর—এসব নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না।
এরকম পরিস্থিতিতে দুই দেশের রাষ্ট্রীয় ও কর্পোরেট মিডিয়াগুলো যেন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত—কে বেশি দেশপ্রেমিক প্রমাণ করতে পারে, কে শত্রু রাষ্ট্রকে বেশি ঘৃণা দেখাতে পারে। ফলে, খবরের শিরোনামে থাকে প্রতিশোধের ভাষা, আর রিপোর্টে থাকে সামরিক সফলতার ঢাকঢোল।
ভারতের দাবি, তাদের বিমান হামলায় ১০০ জঙ্গি নিহত হয়েছে। পাকিস্তানের পাল্টা বক্তব্য, নিহতদের মধ্যে নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ ৩১ জন নিরীহ নাগরিক ছিলেন। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে পাল্টা গুলিতে এক নবজাতকের মৃত্যু হয়। অপরদিকে ভারতের হামলায় ৩ বছরের এক কন্যা শিশুর মৃত্যু হয় প্রশ্ন ওঠে—এই শিশুরা কীভাবে জঙ্গি হলো?
সত্য হারিয়ে যায়, বিভ্রান্তি জন্ম নেয়, আর জাতি যুদ্ধপ্রবণ এক মানসিক আবহে ঢুকে পড়ে। ভয়ের রাজনীতির মাঝে সাধারণ মানুষের কণ্ঠ নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—পাক-ভারত উত্তেজনার নাটকে মূল অভিনেতা সাধারণ মানুষ, আর তারা শুধুই বলিদানের জন্য ব্যবহৃত হয়। কেউ প্রকৃত বিজয়ী হয় না; জয় পায় কেবল ক্ষমতার পেছনে থাকা অপারেশনে দক্ষ গোষ্ঠী। সাময়িক রাজনৈতিক সুবিধা অর্জিত হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা গরিব, শ্রমজীবী, ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য হয় আত্মঘাতী।
উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা—দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব, স্বাস্থ্যসেবার দুরবস্থা, নারীর নিরাপত্তাহীনতা—সব পিছিয়ে পড়ে। সামনের সারিতে চলে আসে জাতীয়তাবাদী শ্লোগান, অস্ত্র ও আতঙ্ক।
ভারত-পাকিস্তান আজকের উত্তেজনাময় আবহে আমাদের স্মরণ রাখা জরুরি : যারা যুদ্ধ চায়, তারা যুদ্ধ করতে যায় না; আর যারা যুদ্ধ চায় না, তারা যুদ্ধের বলি হয়।
এই সত্য মেনে উপমহাদেশের নেতৃত্ব যদি সত্যিকারের উন্নয়ন চায়, তবে যুদ্ধ নয়—প্রয়োজন সমঝোতা, বিশ্বাস, অর্থনৈতিক ও মানবিক অগ্রাধিকার। অন্যথায়, ভবিষ্যতেও এই অঞ্চলের জনগণ রক্তের বিনিময়ে কেবল ক্ষমতাকেন্দ্রের নাটকে দর্শক হয়েই থাকবে।
মন্তব্য করুন