মোস্তফা হোসেইন
প্রকাশ : ১৩ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৩ জুন ২০২৩, ০৮:৩৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

স্থানীয় কোন্দলও ভোগাতে পারে দেশকে

সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মোস্তফা হোসেইন।
সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মোস্তফা হোসেইন।

রাজনীতিতে মতভেদ থাকা স্বাভাবিক। এক দলের সঙ্গে অন্য দলের মতের অমিল কিংবা বিরুদ্ধ মত থাকতে পারে। এমনকি একই দলের ভেতরেও নেতায় নেতায় মতপার্থক্য থাকতে পারে। এ মতভেদকে আমরা বলতে পারি গণতন্ত্র চর্চার একটি অংশ হিসেবে। তবে গণতান্ত্রিক ধারার এ মতপ্রকাশেরও কিছু নীতিনিয়ম থাকে। পদ্ধতি-প্রক্রিয়া থাকে। দলের অভ্যন্তরে কথা বলার অধিকার প্রতিটি সদস্যই সংরক্ষণ করেন। তারা কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও মতপ্রকাশ করতে পারেন, কিন্তু সেই যে পদ্ধতি-প্রক্রিয়া কিংবা নিয়মকানুন সে বিষয়গুলো অত্যন্ত কঠোরভাবে অনুসরণীয়। তা না হলে গণতন্ত্রের জন্য লড়াকু দলটিই ভঙ্গুর হয়ে পড়তে পারে। গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত কোনো দলের ভেতর ভিন্নমত প্রকাশ করতে হয় দলীয় ফোরামে। কিন্তু যখন দল কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তখন আর দ্বিমত কিংবা ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ থাকে না। যদি করা হয় তাহলে তা দলের বিরুদ্ধে চলে যায়। যা আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও দলের বিরোধিতার শামিল। আর সেই অবস্থায় ইচ্ছা করলে দ্বিমত পোষণকারীর বিরুদ্ধে দলীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। আর সেটাই হওয়া উচিত, অন্তত দলের চেইন অব কমান্ড ঠিক রাখার এবং সামষ্টিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্র খুবই সীমিত। সেখানে আদর্শিক বিরোধের চেয়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্বই প্রধান ভূমিকা পালন করে।

আদর্শিক দ্বন্দ্বের কারণে দলের বিরুদ্ধে ফোরামে কথা বলে একমত হতে না পেরে দলত্যাগের ইতিহাস আমাদের দেশে আছে। তবে সংখ্যা খুব বেশি নয়। প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ইতিহাসও যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাব—দলটির প্রথম সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আদর্শগত কারণে দ্বিমত প্রকাশ ও দলত্যাগ করে নতুন দল গঠন করেছিলেন। ব্যারিস্টার আবদুস সালাম বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতম ব্যক্তি হওয়ার পরও তিনি সরে যান। আতাউর রহমান খান, আমেনা বেগম, মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগিশের মতো অনেককেই পাকিস্তান আমলে দলত্যাগ করে ভিন্ন নামে দল গঠন করতে দেখা যায়। আবার নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান ছয় দফার সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করলেও একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে নিজেই কোণঠাসা হয়ে পড়েন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এ ধারা বিভিন্ন দলেই অব্যাহত থাকে। কিন্তু সবচেয়ে দৃষ্টিকটু অবস্থানটি দৃঢ় হয়েছে এই সময়, অভ্যন্তরীণ মতভেদ চার দেয়ালের বাইরে চলে আসার মধ্য দিয়ে। দলের অভ্যন্তরের মতভেদগুলো কখনো কখনো সাধারণ মানুষের ক্ষতিরও কারণ হয়ে থাকে। যা কোনোভাবেই কোনো নিয়মতান্ত্রিক সংগঠনের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

সাধারণত উগ্র কমিউনিস্ট কিংবা উগ্র ধর্মীয় রাজনৈতিক সংগঠনে যে অসহনশীল পরিস্থিতি তৈরি হয় তা গণতান্ত্রিক দলের মধ্যে দেখা দেওয়ার মানে হচ্ছে, দলের জন্য ক্ষতিকর উপাদান সৃষ্টি করা। যা আমাদের প্রায়ই দেখতে হয়। এক নেতার অনুসারীরা হয়তো অন্য নেতার অনুসারীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া করল কিংবা মারামারিতে লিপ্ত হলো। এ অবস্থাটা যেন একবারে নুন-ভাতের মতো হয়ে গেছে আজকাল। নেতিবাচক মতভেদগুলোর সূত্র ধরে বন্দুকবাজি ও খুনোখুনির ঘটনাও আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হয়। অথচ যারা এসব করেন তাদের ধারণা নেই, নিজেদের মধ্যে এই সংঘাত তাদের মূল দলকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

এত বড় উপক্রমণিকা যে কারণে তা ৬ জুন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের পাল্টাপাল্টি পেশি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতার সুবাদে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক তিন ঘণ্টা বন্ধ থাকা। এর পরিণতিতে মহাসড়কে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত যানজট তৈরি হয়। একটি কর্মসূচিকে সামনে এনে দুই গ্রুপে মাঠে নামে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দেওয়ার প্রতিবাদ করার কর্মসূচি। যে কোনো দলই তার সাংগঠনিক প্রধানের ওপর এমন হুমকি এলে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করতে পারে। সুতরাং চৌদ্দগ্রামের সেই আওয়ামী লীগ শাখার কর্মসূচি নিয়ে কিছু মন্তব্য করা ঠিক হবে না। কিন্তু যে মুহূর্তে দেখা গেল আরেকটি গ্রুপ এর বিরুদ্ধে রামদা, লাঠি ইত্যাদি অস্ত্র নিয়ে মহাসড়কে নেমে পড়েছে। নিজেদের শক্তিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সব যানবাহন বন্ধ করে দিয়ে মুহূর্তেই ৩০ কিলোমিটার যানজট তৈরি করেছে, তখন স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন জাগে, এ মানুষগুলো আসলে কার কল্যাণার্থে রাজনীতি করছে। তাদের রাজনীতির মূল লক্ষ্য কী? তারা কি কোনো আদর্শিক দ্বন্দ্বে মত্ত হয়েছে? জবাবগুলো সবার জানা, তাই আলোচনার প্রয়োজন বোধ করছি না।

কিন্তু কুমিল্লার আওয়ামী রাজনীতিতে যে ঐতিহ্যগত বিভাজন রয়েছে, তা বোধকরি এ ঘটনার পর আর ভেঙে বলার প্রয়োজন নেই। বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল খান আর বীর মুক্তিযোদ্ধা বাহাউদ্দীন বাহার এমপির দ্বন্দ্বের ফল যে কী হয়েছে, কুমিল্লার মানুষ তা জানে। এর কুফল দলকেও ভোগ করতে হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল আকবর হোসেন জীবিত থাকাকালে আওয়ামী লীগের চেয়ে কম ভোট পেয়ে একাধিকবার এমপি হতে পেরেছিলেন, সেই আওয়ামী লীগের বিভাজনের কারণে। বাহার-আফজাল গ্রুপের আফজাল খান বিদায় নিয়েছেন দুনিয়া থেকে, কিন্তু দ্বন্দ্বটা রয়ে গেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, চৌদ্দগ্রামের এই মহড়া বাহার-আফজাল গ্রুপের নয়। সাবেক মন্ত্রী বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মুজিবুল হক এমপির পক্ষ-বিপক্ষের কর্মীদের এ সমাবেশই ছিল ৩০ কিলোমিটার যানসৃষ্টির অনুঘটক।

এমনিতেও জেলা আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য। এ ঘটনা দ্বন্দ্বটা আরও প্রকাশিত হলো। বরং জেলা থেকে যে উপজেলা ও ইউনিয়নেও অন্তর্দ্বন্দ্ব মারামারির পর্যায়ে তাই প্রমাণ হলো। কিন্তু এ ঘটনা মূল দলকে কী দিয়েছে? ঘণ্টার পর ঘণ্টা গরমের মধ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোর যাত্রীরা কি প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের শক্তি যাচাই করেছেন? তাদের অনুভূতিগুলো অবশ্যই স্থানীয় রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে নিয়ে হবে না। প্রত্যেক ভুক্তভোগী মূল দলকেই দায়ী করেছে। এটা বলার সুযোগ নেই যে, এমন দ্বন্দ্ব শুধু কুমিল্লাতেই আছে। আর এসব দ্বন্দ্ব যে আদর্শিক নয়, সেটা তো আরও স্পষ্ট।

দলীয় কোন্দলের ফল যে কীভাবে দলকে বহন করতে হয়, প্রত্যক্ষভাবে দেখিয়ে দিয়েছে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। বরিশালে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর চেষ্টা চলছে। কেন্দ্রীয় নেতারা সেখানে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। কিন্তু স্থানীয়দের ঐক্য না থাকলে কেন্দ্রীয় নেতারা কতটা সফল হবেন, তা দেখার জন্য কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে আরও। এই দলীয় কোন্দল কি শুধু আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে? চোখ-কান খোলা প্রতিটি মানুষ জানে, এটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক চরিত্র। বড়-ছোট নির্বিশেষে সব দলেই দৃষ্টিকটু এ দ্বন্দ্ব বিরাজমান। ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। কিন্তু বিরোধী দল বিএনপিতেও মারামারির সংবাদ হয় প্রায়ই। টেলিভিশনগুলো সমাবেশের ছবি তোলার জন্য গিয়ে চেয়ার মারামারির ছবি প্রকাশ করতে প্রয়োজন বোধ করে। মাঝেমধ্যেই দেখা যায় বিএনপির সমাবেশে নিজেরা কীভাবে চেয়ার তুলে নিজেদেরই মারছে। তাদেরও এ দ্বন্দ্বের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। ১৯৮৮ সালে ছাত্রদল নেতা বজলুর রহমান শহীদ ওরফে পাগলা শহীদকে হত্যা করা হয়েছিল, ছাত্রদলের ইলিয়াস গ্রুপ ও রতন গ্রুপের মারামারিতে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির মৃত্যু, ১৯৯২ সালে মামুন ও মাহমুদ নামের দুই ছাত্রদল নেতার হত্যাকাণ্ড সেই প্রমাণ বহন করে। এর মধ্যে মামুনকে হত্যা করে পানির ট্যাঙ্কে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। এ দ্বন্দ্ব শুধু বড় দলেই সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয়। ক্ষুদ্র দলগুলোও কি পিছিয়ে আছে? ক্ষুদ্র দলগুলো এ দ্বন্দ্বের কারণেই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে পড়ে বাংলাদেশে। তাদের বিভাজন নিয়ে চটকদার কথাও চালু আছে। বলা হয়, টেম্পো পার্টি থেকে বাস পার্টি হয়ে যাওয়ার আগেই তারা রিকশা পার্টি হয়ে যায়। অতি বাম রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিপক্ষকে গুলি করে হত্যার ঘটনাও আছে বাংলাদেশে। এ ধরনের দলীয় কোন্দল স্থানীয় পর্যায়ে হলেও এর প্রভাব কেন্দ্রীয়ভাবেও পড়ে। আর যখন চৌদ্দগ্রাম উপজেলার দ্বন্দ্বের কারণে পুরো ঢাকা-চট্টগ্রাম রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় দীর্ঘ সময়ের জন্য, তখন আর সেটা চৌদ্দগ্রামের বিষয় থাকে না। তার দায় বহন করতে হয় পুরো দলকেই। মনে রাখার প্রয়োজন আছে, বছরটা নির্বাচনের। বড় দলগুলো যদি এভাবে হানাহানিতে লিপ্ত থাকে, তার জন্য বড় রকমের খেসারতও দিতে হতে পারে। এটা সবার জন্যই প্রযোজ্য। স্থানীয় পর্যায়ের কোন্দল জাতীয় রাজনীতিকে কলুষিত করার জন্য যথেষ্ট। তাই যেখানেই এমন কোন্দল আছে সেখানেই কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক। প্রয়োজনে কোন্দলে লিপ্তদের বিরুদ্ধে বহিষ্কারের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিতে হলেও দলের জন্য খুব বড় ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না।

লেখক : সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পপুলার ফার্মায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি

পুতিন-মোদি বৈঠক, পারস্পরিক সাহায্যে জোর

বঙ্গোপসাগরে গভীর নিম্নচাপ, ঘূর্ণিঝড়ের শঙ্কা

আজ টিভিতে দেখা যাবে যেসব খেলা

কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

তেলবাহী ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত, খুলনার সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ

২৩ অক্টোবর : নামাজের সময়সূচি 

বুধবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

‘সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা হবে’

ইউএনএফপিএ এবং জাপান সরকারের মাঝে ৪০ কোটি টাকার সহায়তা চুক্তি

১০

‘রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসে কোনো চক্রান্ত করার সুযোগ দেওয়া হবে না’

১১

বুলগেরিয়ায় পড়তে ইচ্ছুক বাংলাদেশিদের জন্য সুখবর

১২

ভিনির দুর্দান্ত হ্যাটট্রিকে রিয়ালের অসাধারণ জয়

১৩

ঘূর্ণিঝড় ডানার তাণ্ডব চলবে রাত থেকে ভোর পর্যন্ত

১৪

টানা দ্বিতীয় হারে এশিয়া কাপ থেকে বাংলাদেশের বিদায়

১৫

বঙ্গভবন এলাকা থেকে আন্দোলনকারীদের সরে যাওয়ার আহ্বান হাসনাত-সারজিসের

১৬

বাংলাদেশ সিরিজের জন্য আফগানিস্তানের দল ঘোষণা

১৭

প্রধান উপদেষ্টার একান্ত সচিব হলেন মোজাম্মেল হক

১৮

প্রধান উপদেষ্টা সুস্থ আছেন, গুজব না ছড়ানোর অনুরোধ

১৯

যুক্তরাজ্য বিএনপির সম্পাদক কয়ছরকে জগন্নাথপুরে গণসংবর্ধনা

২০
X