শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
মহসীন হাবিব
প্রকাশ : ২৬ মার্চ ২০২৪, ০২:২০ এএম
আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২৪, ০৯:১৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

৫৩ বছরে কী পেয়েছি আর কী বাকির খাতায়

৫৩ বছরে কী পেয়েছি আর কী বাকির খাতায়

নিবন্ধে বহু বিষয় অ্যাড্রেস করার মতো অবস্থা বিরাজ করছে। সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে বাংলাদেশের নাবিকসহ জাহাজ আটক রয়েছে দুই সপ্তাহ ধরে। পৃথিবীর বড় বড় দেশের ৩০টি যুদ্ধজাহাজ অ্যাডেন উপসাগর, সোমালিয়া উপকূল পাহারায় রয়েছে। ছোট্ট ডিঙি নিয়ে বিশাল জাহাজে উঠে পড়ছে হাড়সর্বস্ব কিছু সোমালি জলদস্যু। এর পেছনের রহস্য নিয়ে লেখা হতে পারত। ভ্লাদিমির পুতিনের দেশ রাশিয়ায় ভয়াবহ হামলায় শতাধিক মানুষের নিহত হওয়া এবং এর আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটও আরও একটি লেখার বিষয় ছিল। কান্তিজিউর মন্দিরের জমি দখলের দুঃসাহস ও বাংলাদেশের পরিস্থিতিও আলোচনার বিশেষ দাবি রাখে। কিন্তু আজ যেহেতু ২৬ মার্চ, তাই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে, এই ৫৩ বছরে আমরা কী পেয়েছি, রাজনীতিবিদরা আমাদের কী দিতে পেরেছেন এবং কী দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।

একটি ভুলে যাওয়া ঘটনা দিয়ে শুরু করি। একজন ব্যক্তি ছিলেন এন্তাজ উদ্দিন আহমেদ। ই ইউ আহমেদ নামেই পরিচিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সময়ে তাকে পরিত্যক্ত সম্পত্তির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি পরবর্তীকালে স্বল্প মূল্যে প্রচুর সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে সেই আমলে ১০০ কোটি টাকা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। তখন বাংলাদেশি ১০০ কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রেরও অনেক টাকা। তখন ১ ডলারের মূল্য ছিল ১৫-২০ টাকা। এ নিয়ে তৎকালীন দুর্নীতি দমন সংস্থা (পরে ব্যুরো এবং তারপর কমিশন নাম হয়) ছয়টি মামলা করে। ততদিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শহীদ হয়েছেন। মোশতাক-জিয়ার ক্ষমতার পর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গদিনাসীন হন দীর্ঘ ৯ বছরের জন্য। ওই মামলা তখন চলমান, যা হয়ে থাকে আমাদের দেশে। সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেট দলের প্রভাবশালী কংগ্রেসম্যান ছিলেন স্টিফেন সোলার্জ। ১৯৮৮ সালে তিনি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য ফরেইন অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাক্ট সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যাহোক, এই স্টিফেন সোলার্জ যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে একটি চিঠি দেন। তখন রাষ্ট্রদূত ছিলেন সম্ভবত আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ অথবা এ এইচ এস আতাউল করিম। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, এন্তাজ উদ্দিন একজন সম্মানী ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী। তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে যে মামলা রয়েছে তা সতর্কতার সঙ্গে দেখতে হবে। চিঠির ভাষা যাই হোক, কারও বুঝতে বাকি ছিল না যে সোলার্জ তাকে ছেড়ে দিতে বলছেন। তখন স্বৈরশাসকরা যুক্তরাষ্ট্রের মুদি দোকানদারও কিছু বললে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেন তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে। এই চিঠি রাষ্ট্রদূত পাঠিয়ে দেন এরশাদের কাছে। এরশাদ কাপড়চোপড় ভিজিয়ে ফেলেন। তিনি তখনই দ্বিতীয় কোনো চিন্তা না করে দুর্নীতি দমন সংস্থাকে নির্দেশ দেন সবকটি মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দিতে। দেশের কর্মকর্তাদের কাছে তখন প্রেসিডেন্ট এরশাদ বলে কথা! হুড়োহুড়ি পড়ে যায় ফাইনাল রিপোর্ট দিয়ে মামলা ক্লোজ করে দিতে। তখন প্রশাসন ও জুডিশিয়ারি পৃথক ছিল না। ম্যাজিস্ট্রেট কোনোক্রমেই মামলার ফাইনাল রিপোর্ট গ্রহণ করবেন না। উচ্চপদস্থ প্রশাসন কর্মকর্তারা ম্যাজিস্ট্রেটকে জাপটে ধরে বলেন, হারে! প্রেসিডেন্টর অর্ডার! ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, মামলার বিবাদী অনুপস্থিত থাকলে ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়ার সুযোগ নেই। দরকার হয় আমাকে বদলি করে দেন! শেষ পর্যন্ত সেই ভয়ানক চৌর্যবৃত্তির মামলা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এটি অতীতের একটি উদাহরণ মাত্র। এ উদাহরণ এখনো অপরিবর্তিত।

বহু বছর পার হয়ে গেছে আমরা স্বাধীন হয়েছি। এখন আর শেখ হাসিনাকে বিদেশিদের অন্যায় আবদার না শুনলেও চলে। বরং তিনি ওইসব শক্তিধর দেশকে মোকাবিলা করে চলতে শিখেছেন। দেশের আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে অস্বীকার করার উপায় নেই। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে প্রধানমন্ত্রী অবকাঠামো উন্নয়নে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছেন। এই সাফল্যগাথা উল্লেখ করতে গেলে পরীক্ষার হলে ছাত্রদের এক্সট্রা পাতা নেওয়ার মতো অনেক পাতা নিতে হবে। কিন্তু অতি দুঃখের বিষয় প্রশাসন যন্ত্রে সামান্য পরিবর্তন আসেনি। বরং রাজনৈতিক দুর্বলতার ফাঁকফোকর দিয়ে প্রবেশ করে প্রশাসন এখন মনস্টারে পরিণত হয়েছে, যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে তার বিরুদ্ধে বৈপ্লবিক অভিযান ছাড়া পরিস্থিতি পাল্টানো যাবে না। ২০১৪ সালে বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকতে রোমানিয়ায় শিক্ষার্থীদের এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘Corruption is a cancer, a cancer that eats away at a citizen’s faith in democracy, diminishes the instinct for innovation and creativity; already-tight national budgets, crowding out important national investments. It wastes the talent of entire generations. It scares away investments and jobs. And most importantly it denies the people their dignity. It saps the collective strength and resolve of a nation. Corruption is just another form of tyranny.’

যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন পলিসি যাই হোক, জো বাইডেনের এই বক্তব্য যে চির সত্য, সে কথা আমরা মনে রাখলে ভালো করব। দুর্নীতি হয়তো সম্পূর্ণ মুক্ত করা সম্ভব নয় রাতারাতি, কিন্তু এর হাল টেনে ধরা জরুরি হয়ে পড়েছে। সমাজকেও ধ্বংস করে দিচ্ছে এই করাপশন; নীতি-নৈতিকতা তলানিতে নিয়ে ঠেকিয়েছে। আগে যারা দুর্নীতি করতেন, তারা এক ধরনের অপরাধ বোধ করতেন, পরিবার, আত্মীয়স্বজনের কাছে তার দুর্নীতির কথা প্রকাশ হতে দিতেন না। এখন পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠেছে, জামাইয়ের দেড় কোটি টাকা ঘুষের ভারী বস্তা শ্বশুরমশাই বয়ে নিয়ে আসেন। অসংখ্য মানুষ দেখি যারা ঘুষের ডিপার্টমেন্টে চাকরি করা লোকের কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে ছোটাছুটি করেন। যারা করাপশনের সঙ্গে জড়িত তারা প্রকাশ্যেই তাদের ‘ব্যবসা’ চালাচ্ছেন, কোনো লাগাম টানছেন না। ফলে গোটা সমাজই এ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। কি সিএনজিচালক, কি তরকারির দোকানদার, আর কি দুধ বিক্রেতা। এই দুধ বিক্রেতার কথা বলায় রাজমেখর বসুর ‘ভেজাল ও নকল’ প্রবন্ধের কথা মনে পড়ল। তিনি লিখেছিলেন মোটামুটি এরকম—“নন্দ গোয়ালা দুধে জল দিচ্ছে। আপত্তি জানালে আকাশ থেকে পড়ে উত্তর দিল, বলেন কি বাবু! আপনি পুরোনো খরিদ্দার, আপনাকে কি ঠকাতে পারি? পাপ হবে যে!

বললাম, দেখ নন্দ দুধে অল্পস্বল্প জল থাকলে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু এখন বাড়াবাড়ি রকম জল দিচ্ছ। তোমার সঙ্গে আমার বহুকালের সম্পর্ক। সত্যি কথা বল।

নন্দ লোকটি সজ্জন। সে মাথা চুলকে বলল, আজ্ঞে সেরপ্রতি মোটে আধা পোয়া দিচ্ছি। পরিষ্কার কলের জল। আমার কাছে তঞ্চকতা পাবেন না বাবু।

নন্দ, আরেকটু সত্যি করে বলো।

আজ্ঞে এক পোয়ার বেশি জল কোনোদিনই দেই না। আমার এ গলার কণ্ঠির দিব্বি।”

শেষ পর্যন্ত নন্দ যে এক পোয়ার বেশি জল মেশায় না তা রাজশেখর বসুর তার প্রবন্ধে বিশ্বাস করলেন। এই বিশ্বাসটুকুও স্বাধীন বাংলাদেশে এখন আর অবশিষ্ট নেই। পুরো বাজার জিম্মি হয়ে গেছে ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ফড়িয়া ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে। আর এ ধাক্কা সামাল দিতে অন্যান্য পেশার লোকেরা যে যেখানে আছেন তারা ১৪ নম্বরি ১৫ নম্বরির আশ্রয় নিচ্ছেন। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি গোটা বিশ্বের কোনো স্বাভাবিক দেশে (অর্থাৎ যেখানে যুদ্ধ নেই অথবা যেটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের তকমা পায়নি) বাংলাদেশের মতো খাদ্যদ্রব্য মূল্য চড়া নয়। আর এই অভিশপ্ত পরিস্থিতির পেছনে আছে কিছু রাজনীতিবিদ ও প্রশাসন। আমরা কিছু শব্দটি ব্যবহার করি ‘সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ’ হিসেবে। প্রকৃত অবস্থা আমাদের সবারই জানা। এই দেশে এখন একজন সৎ ও কর্মঠ মানুষ দেখা গেলে তা সংবাদ হয়ে ওঠে।

যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ উন্নয়নের বিশেষ প্রয়োজন ছিল অর্থনৈতিক কারণেও। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে মরিয়া হয়ে উন্নয়ন করেছেন। এখন সময় এসেছে প্রধানমন্ত্রীর সামনে দেশকে সোনার বাংলা তৈরি করার। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “বঙ্গবন্ধু ক্ষমতার রাজনীতি করে নাই। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য।” তিনি আরেকবার বলেছিলেন, “অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদের সঙ্গে কোনোদিন এক হয়ে দেশের কাজে নামতে নেই। তাতে দেশ সেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।”

এসব বক্তব্যও কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তার স্বপ্ন বাস্তবায়নটাই আমরা দেশের জনগণ এখন দেখতে চাই।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সিলেটে ফের বিরতি ফিলিং স্টেশনে আগুন

এক হাজার সফল সার্জারি সম্পন্ন করেছে ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল

আলুর হিমাগারে মিলল লাখ লাখ ডিম

শিক্ষার্থীদের বাস নিয়ে প্রোগ্রামে তিতুমীর কলেজ ছাত্রলীগ

মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

যুদ্ধ শেষে গাজায় যে পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র

দেড় শতাধিক লোকসহ টুঙ্গিপাড়ায় যাচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুছ

স্ত্রীর স্বীকৃতির দাবিতে নাদিমের বাড়ি ৪৩ বছরের নারীর অনশন

‘পিডাইয়া লম্বা করে দেন, বহু উপরের নির্দেশ’

পাকিস্তানের হাতে অত্যাধুনিক রকেট, আতঙ্কে শত্রুদেশগুলো

১০

আন্তর্জাতিক আবৃত্তি উৎসব ১৭ মে

১১

মহাসড়কে হঠাৎ গুলি, নারী আহত

১২

‘চট্টগ্রাম বন্দর একদিন পৃথিবীর অন্য দেশের কার্যক্রম পরিচালনা করবে’

১৩

শাবিতে মাহিদ মেমোরিয়াল ফুটবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধন

১৪

‘বারবার নীতি পরিবর্তন করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর আস্থা কমে যাবে ব্যবসায়ীদের’

১৫

হাজিদের স্বাগত জানাচ্ছে নারীরা!

১৬

কক্সবাজারের রূপে সাজবে পতেঙ্গার সি-বিচ

১৭

সরকার পরিবর্তনে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের বিকল্প নেই : মির্জা ফখরুল

১৮

ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে গরু ছিনতাইয়ের মামলা

১৯

উচ্চশিক্ষার জন্য নরওয়েতে যাচ্ছেন চুয়েটের ৮ শিক্ষার্থী

২০
X