কালবেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:৪৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

‘মা বানিয়ে’ ভক্তের সাত কোটি টাকা হাতিয়ে নিল প্রতারক ‘দরবেশ’

গ্রেপ্তার তানজিল ও হাসেম। ছবি : সংগৃহীত
গ্রেপ্তার তানজিল ও হাসেম। ছবি : সংগৃহীত

দরবেশ পরিচয়ে একজনের কাছ থেকেই হাতিয়ে নেয় ৭ কোটি টাকা। প্রতারণার জন্য প্রথমে বিভিন্ন পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিত এই চক্র। পরবর্তী সময়ে অনলাইনে (ইউটিউব ও ফেসবুক) বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করে। প্রতি মাসে ফেসবুকে ৪ লাখ টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিত এবং পোস্ট বুস্ট করত যাতে তার বিজ্ঞাপন সব মানুষের কাছে পৌঁছে যায়।

মধ্য প্রাচ্যে কর্মরত স্বল্প শিক্ষিত প্রবাসী বাঙালিদের টার্গেট করে সৌদি আরব, দুবাই, ওমানসহ সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াতে দেশভিত্তিক বিজ্ঞাপন প্রচার করত। এ ছাড়াও ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইতালি ও ফ্রান্সে বিজ্ঞাপন প্রচার করত। এভাবে পত্রিকা, টিভি চ্যানেল, ইউটিউব ও ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে দরবেশ বাবার ছদ্মবেশ ধারণ করে প্রতারণা করত চক্রটি। আর প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক কোটি টাকা।

এমন একটি প্রতারক চক্রের মূলহোতাসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গ্রেপ্তারকৃত চক্রের মূল হোতা মো. হাসেম ও তার সহযোগী মো. তানজিল আহমেদ ওরফে তানজিদ হাসান। রোববার (১৭ সেপ্টেম্বর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সিআইডি এ তথ্য জানায়।

সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৬০ বছরের একজন বৃদ্ধার (অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা) অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের একটি টিম। ঢাকার উত্তরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রথমে অভিযুক্ত তানজিল আহমেদকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যে চক্রের মূল হোতা হাসেমকে ভোলার বোরহানুদ্দিন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সিআইডি জানায়, অভিযোগকারীর তিন ছেলেমেয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত। তারা দেশের বাইরে থাকেন। তার স্বামী দেশের একজন নামকরা চিকিৎসক। চাকরি থেকে অবসরের পর ভুক্তভোগী দিনের অধিকাংশ সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাটান। কিছুটা পারিবারিক সমস্যায়ও ভুগছিলেন। তিনি এ থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে থাকেন। একপর্যায়ে হঠাৎ একদিন ফেসবুক স্ক্রল করার সময় তিনি একটি বিজ্ঞাপন দেখতে পান। বিজ্ঞাপনে তিনি দেখতে পান, একজন সুন্দর সৌম্য চেহারার দরবেশ বেশধারী ব্যক্তি নিজেকে সৌদি আরবের মসজিদে নববীর ইমাম পরিচয় দিয়ে বলছেন, তিনি কোরআন হাদিসের আলোকে মানুষের সমস্যা সমাধানে কাজ করেন। স্বামী-স্ত্রীর অমিল, বিয়ে না হওয়া, বাচ্চা না হওয়া, লটারি জেতানোসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেন। বিজ্ঞাপনে দুজন মেয়ের সাক্ষাৎকার দেখায়, যেখানে মেয়ে দুটিকে বলতে শোনা যায়, তারা এই দরবেশ বাবার কাছ থেকে তাদের সমস্যার সমাধান পেয়েছেন।

এটা দেখে অভিযোগকারী ভুক্তভোগী তার বাসার কাজের মেয়ের সাথে বিষয়টি আলোচনা করেন। কাজের মেয়ে তখন তাকে জানান, জিন-পরীর মাধ্যমে দরবেশ বাবারা এসব সমস্যার সমাধান করে। তার গ্রামের কয়েকজনের এভাবে সমস্যার সমাধান হয়েছে। এটা শুনে ভুক্তভোগী উৎসাহিত হয়ে বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা মোবাইল নম্বরে ফোন করেন। ফোন দেওয়ার সাথে সাথে বিজ্ঞাপন দেওয়া দরবেশ বাবা বেশধারী ব্যক্তি তার সাথে খুব সুন্দর করে কথা বলে তার পারিবারিক সমস্যা শুনতে চান। তিনি তখন তার পারিবারিক কিছু সমস্যার কথা ওই দরবেশ বাবার সাথে আলোচনা করেন।

দরবেশ বাবা পরিচয়ধারী ব্যক্তি তার সমস্যার কথা শুনে তাকে বলেন, ‘মা তোমার সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। বাবার ওপর আস্থা রাখ। আমি তোমাকে ‘মা’ বলে ডাকলাম। আজ থেকে তুমি আমার মেয়ে। তবে কিছু খরচ লাগবে মা। খরচের কথা কাউকে জানানো যাবে না। যদি জানাও তবে তোমার সমস্যার সমাধান হবে না। বিপরীতে তোমার সমস্যা আরও বাড়বে এবং তোমার ছেলেমেয়ে ও স্বামীর ক্ষতি হবে।’ এমন সুন্দর ব্যবহার ও কথা বলে দরবেশ বাবা তার বিকাশ নম্বরে একটা বড় অ্যামাউন্টের টাকা বিকাশ করতে বলে।

দরবেশ বাবার সুন্দর ব্যবহার ও কথায় তার ভক্ত হয়ে যান ভুক্তভোগী। তখন ওই নম্বরে দরবেশ বাবার কথা মতো বিকাশে টাকা পাঠান। এভাবে বিভিন্ন তারিখ ও সময়ে দরবেশ বাবা ভুক্তভোগীকে ফোন করে বিভিন্ন অজুহাতে ও ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় সাত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। পরে একসময় ভুক্তভোগী বুঝতে পারেন তিনি প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন। পরে তিনি মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন এবং সিআইডিতে অভিযোগ করেন।

অভিযোগ পেয়ে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার ঘটনার অনুসন্ধান করে ঘটনায় জড়িত চক্রটিকে শনাক্ত করে এবং তাদের অবস্থান শনাক্ত করে উত্তরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত তানজিল আহমেদকে গ্রেপ্তার করে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যে ভোলার বোরহানউদ্দিন থেকে গ্রেপ্তার করা হয় চক্রের মূল হোতা হাসেমকে।

তানজিল আহমেদকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, চক্রের মূল হোতা হাসেম প্রথমে বিকাশ ও রকেটের মাধ্যমে ছোট ছোট অ্যামাউন্টের টাকা নিত। এরপর বড় অ্যামাউন্টের টাকা নেওয়ার সময় তানজিল আহমেদকে অভিযোগকারী ভুক্তভোগীর কাছে পাঠাতো এবং একসাথে ৩০-৪০ লাখ টাকা নিয়ে যেত। এভাবে ধাপে ধাপে তারা প্রায় সাত কোটি টাকা নেয়।

প্রতারক হাসেমকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে সিআইডি জানায়, তিনি ২০০৫ সাল থেকে এই কাজ করছেন। প্রথম দিকে তিনি বিভিন্ন পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিতেন। পরে ২০১৬ সাল থেকে পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের পাশাপাশি ইউটিউব ও ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করেন। প্রতি মাসে ফেসবুকে ৪ লাখ টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিতেন এবং সবার কাছে পৌঁছাতে পোস্ট বুস্ট করতেন। তিনি মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত স্বল্প শিক্ষিত প্রবাসী বাঙালিদের টার্গেট করে সৌদি আরব, দুবাই, ওমানসহ সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াতে দেশভিত্তিক বিজ্ঞাপন প্রচার করতেন।

এ ছাড়াও তিনি ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইতালি ও ফ্রান্সে বিজ্ঞাপন প্রচার করতেন। এভাবে তিনি পত্রিকা, টিভি চ্যানেল, ইউটিউব ও ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়ার মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে দরবেশ বাবা পরিচয় দিয়ে কথা বলতেন ও তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ভয়-ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে কৌশলে টাকা হাতিয়ে নিতেন। দরবেশ বাবার পরিচয় ধারণকারী প্রতারক হাসেম হিন্দি ও আরবি ভাষায় কথা বলাসহ বিভিন্ন রকম কণ্ঠে (জিন-পরীর কণ্ঠ, ২০০ বছরের হুজুরের কণ্ঠ, ১০০ বছরের বাবার কণ্ঠ) কথা বলতে পারেন।

সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বলেন, প্রতারক হাসেম দরবেশ বাবা পরিচয়ে ফ্রান্স প্রবাসী ইমাম হোসেন নামের একজন ভুক্তভোগীর কাছ থেকে ১২ কোটি টাকার লটারি জিতিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়া অন্য আরেকজন ইতালি প্রবাসীর কাছ থেকে অনুরূপভাবে লটারি ও জুয়ায় টাকা জিতিয়ে দেয়ার কথা বলে প্রায় ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

সিআইডি সূত্র জানায়, সাইবার পুলিশের টিম খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, ফ্রান্স প্রবাসী ইমাম হোসেনের পরিবার দেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে থাকে। ওই প্রবাসীর বউ-বাচ্চা খেয়ে না খেয়ে অত্যন্ত কষ্টে দিনযাপন করছেন। অথচ প্রবাসে তার কষ্টের উপার্জন করা টাকায় ভণ্ড দরবেশ বাবা বাড়ি-গাড়ি করে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। প্রবাসী ইমাম হোসেন একপর্যায়ে তার বড় বোনকেও দরবেশ বাবার ভক্ত বানিয়ে ফেলে। বড় বোন তার ছেলের ইউনির্ভাসিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য জমানো টাকা পর্যন্ত ভাইয়ের কথায় দরবেশ বাবাকে দিয়ে দিয়েছেন।

অনুসন্ধানে সিআইডি জানতে পেরেছে, মধ্য প্রাচ্যে এই প্রতারক চক্রের এ রকম ২০-২৫ জন ক্লায়েন্ট আছে, মালয়েশিয়াতে আছে ১০-১২ জন। এর মধ্যে ৫-৬ জন ফিক্সড ক্লায়েন্ট আছে, যারা গত ৪-৫ বছর ধরে নিয়মিত এই দরবেশ বাবা নামধারী প্রতারককে টাকা দিয়ে আসছেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নাসিরনগরে দুপক্ষের সংঘর্ষে কৃষক নিহত 

‘সবাইকে কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে এসে একযোগে কাজ করতে হবে’

ভারতের ৩৬ জায়গায় পাকিস্তানের ৪০০ হামলা

কর্ণফুলীর তীরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ সিএমপি কমিশনারের

অভিযোগও ভারতের, রায়ও ভারতের, হামলাও ভারতের : পাকিস্তান সেনার মুখপাত্র

আ.লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সদস্য সাগর গ্রেপ্তার

ঐক্যবদ্ধ শাহবাগ বিএনপির অপেক্ষায় : সারজিস

‘এই দেশ কোনো ব্যক্তি বা দলের নয়, জণগণের’

পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াল আরও এক মুসলিম দেশ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির নেতৃত্বে শ্যামল-সিরাজ

১০

পাকিস্তানে থাকা রিশাদ-নাহিদের অবস্থা নিয়ে যা বলছে বিসিবি

১১

আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে উত্তাল শাহবাগ, বাড়ছে জনস্রোত

১২

ভারতে এক রাতে ৫০০ ড্রোন হামলা

১৩

আপাতত এক সপ্তাহের জন্য স্থগিত আইপিএল

১৪

কৃষকের ৬ বিঘা জমির ধান পুড়িয়ে দিল দুর্বৃত্তরা

১৫

ভারতের চীনা পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্র উদ্ধার, কতটা ভয়ানক?

১৬

ভাঙা হলো মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা সেই সেতুটি

১৭

আপ বাংলাদেশে আহ্বায়ক কমিটিতে পদ পেলেন যারা

১৮

‘গণহত্যাকারীদের রাজনৈতিক অধিকার দিলে সমাজে হত্যাকে উৎসাহিত করা হবে’

১৯

সমাবেশে মোবাইল ফোন হারালেন নুর

২০
X