নীলফামারীর ডিমলায় ভারত থেকে ধেয়ে আসা নাউতারা নদীর ওপর পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়েছিল বছর দুয়েক আগে। ইতোপূর্বে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উদ্যোগে নদীটির পুনঃখনন করা হয়। এ সময়ে উজানের ঢলে স্লুইসগেটসহ ওই নদীর উপরে থাকা অন্তত ৫টি সেতু দেবে গিয়ে ভেঙে পড়েছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন নদীপাড়ের শত শত বাসিন্দা। এ অবস্থার জন্য তারা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দিকে অভিযোগের তীর ছুড়ছে। তবে বিষয়টি জানে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
সেতু ও স্লুইচগেটের এ অবস্থার জন্য স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ও পাউবো পরস্পরের সমন্বয়হীনতার অভিযোগ তুলেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে নাউতারা নদীর ২৫ কিলোমিটার এলাকা খননযন্ত্র (এস্কেভেটর) দিয়ে নদী পুনঃখনন করে। খননের এক মাস যেতে না যেতেই বর্ষায় উজানের ঢলে নদীর ওপরে থাকা স্লুইসগেট ও সেতু দেবে যায়।
সরজমিনে জানা যায়, উপজেলার পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের মধ্যপাড়া এলাকায় বছর দশেক আগে নাউতারা নদীর ওপর কৃষি ফসল বৃদ্ধিতে পানির সঠিক ব্যবহার এবং বন্যার কবল থেকে ফসল বাঁচাতে প্রায় ৫০ মিটার একটি স্লুইসগেট নির্মাণ করে নীলফামারী পানি উন্নয়ন বোর্ড।
২০২১ সালের শেষের দিকে অপরিকল্পিতভাবে নদী খননের পর নিচের অংশের মাটি সরে স্লুইসগেটটির প্রায় ৬ ফুট দেবে যায় আর এতে গেট অকেজো হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে নদীর গতিপথ বদলে যায়। ফলে স্লুইসগেটের দুই পাশের সংযোগ সড়কসহ ৫টি বসতবাড়ি ও মধ্যপাড়া সড়কটি নদীতে বিলীন হয়ে যায়।
স্থানীয় কৃষকেরা বলেন, অপরিকল্পিত নদী খননের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দেবে যাওয়া স্লুইসগেট এখন এটা তাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন নদীর পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে তাদের কৃষিজমি ভাঙছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে শতাধিক বসতবাড়ি ও রাস্তা। এ ছাড়া এই স্লুইসগেটের দেখভালের দায়িত্ব কার সেটাও জানেন না তারা। দেবে যাওয়ার পর কেউ দেখতেও আসেননি। তাই এর কোনো সংস্কারও হয়নি।
নদী ভাঙনের শিকার মধ্যপাড়া গ্রামের রবিউল ইসলাম বলেন, নদী খননের সময় স্লুইসগেট আর রাস্তার সর্বনাশ হয়েছে। গভীর করে নদী খনন করায় স্লুইস গেটটি দেবে যায়। এতে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে বাঁধসহ আমাদের বসতভিটা ও ফসলি জমি নদীতে ধসে গেল।
বিগত সময়ে ছাতনাই মিয়াপাড়া গ্রামে ২০১৬ সালের দিকে নির্মাণ করা হয় ২০ মিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতু। নদী খননের পর পুরো সেতুটির ৫ ফুট দেবে ভেঙে পড়েছে। এমনকি দুপাশের সংযোগ সড়কের মাটিও সরে গেছে।
ওই গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা লালমিয়া বলেন, সেতুটি ভেঙে পড়ায় তাদের প্রায় ২ কিলোমিটার পথ ঘুরতে হচ্ছে। এতে সময় এবং অর্থ দুটোই অপচয় হচ্ছে। যানবাহন ঢুকতে না পারায় এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষিকাজ অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে। কেউ অসুস্থ হলে ঘাড়ে চেপে নদী পার হতে হয়। একই গ্রামের ৬০ মিটার দৈর্ঘ্যের আরেকটি সেতুর মাঝ বরাবর ৩ ফুট দেবে গেছে। এখন ভেঙে পড়ার ক্ষণ গুণছে ডিমলা-পূর্ব ছাতনাই মূল সড়কের সেতুসহ একাধিক সেতু।
নদী পাড়ের আলী আজগর, মফিজুল উদ্দিন, আবুল খায়েরসহ অন্তত ২০ বাসিন্দা জানিয়েছেন, সেতুর খুঁটির গভীরতা বিবেচনায় না নিয়ে অতিরিক্ত গভীর করে নদী খনন করা হয়েছে। তা ছাড়া নদীর দুই পাশে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না রেখে অপরিকল্পিত বাঁধ দেওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতে তাদের হাজারও একর ফসলি জমি জলাবদ্ধ হয়।
পূর্ব ছাতনাই ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ খান বলেন, সেতুর পাইলিংয়ের চেয়ে নদী খননের গভীরতা বেশি হওয়ায় পিলারের নিচের মাটি সরে গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ সেতু দিয়ে ভারি যানবাহন চলাচল করছে। সেতু ভেঙে দুর্ঘটনায় আশঙ্কা করছেন তিনি।
জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী ফিরোজ হাসান বলেন, এ বিষয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। বিষয়টি জেনে জানাব।
নীলফামারীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, আমি সদ্য যোগদান করেছি মাত্র। তাই ভেঙে পড়া স্লুইসগেটের বিষয়টি জানা নেই। খোঁজখবর নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
তবে অপরিকল্পিত নদীখননের অভিযোগটি অস্বীকার করে ডালিয়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদদৌলা বলেন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি নিষ্কাশনের জন্য পরিমাপ অনুযায়ীই নদী পুনঃখননের কাজ হয়েছে। সেতুগুলো তৈরি করা হয়েছে অনেক আগে। তখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পাউবোর সমন্বয়হীনতার কারণে নদীর পরিমাপ বিবেচনায় আনা হয়নি। ফলে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
মন্তব্য করুন