বাংলাদেশের বৃহত্তম বিল চলনবিল। দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রায় হাজার মাইলের বিস্তীর্ণ এ জলাভূমিতে এক সময় বছরের সব সময়ই থাকত পানির প্রবাহ। ধারণা করা হয়, বিলের পানি নদীর স্রোতের মতো চলন্ত বা গতিশীল ছিল বলে এর নামকরণ করা হয় চলনবিল। শুষ্ক মৌসুমে বিস্তীর্ণ এলাকা পরিণত হয় ফসলের মাঠে।
চলনবিলের উৎপাদিত ধান দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় বড় ভূমিকা পালন করে আসছে। এক সময় এই বিলের মাছ দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি হতো। চলনবিলের সেই জৌলুস এখন আর নেই। যুগে যুগে মানুষের বসতি, নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ দখল-দূষণে চলনবিল শুধু সংকুচিতই হয়নি, হারিয়ে ফেলছে তার চিরচেনা বৈশিষ্ট্য।
১৯১৯ সালে প্রকাশিত ইম্পেরিয়াল গেজেট অব ইন্ডিয়ার রাজশাহী অংশে বলা হয়েছে, চলনবিলের মোট আয়তন ৫৫০ বর্গমাইল বা ১ হাজার ৪২৪ দশমিক ৫ বর্গকিলোমিটার। পূর্ববঙ্গ রেলওয়ে কর্তৃক ১৯৪০ সালে প্রকাশিত ‘বাংলার ভ্রমণ’ গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, এ বিলের আয়তন ৪৪১ বর্গমাইল বা ১ হাজার ১৪২ দশমিক ১৮ বর্গকিলোমিটার। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত গ্রন্থে অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ চলন বিলের আয়তন লেখেন ৮০০ বর্গমাইল বা ২ হাজার ৭২ বর্গকিলোমিটার।
ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) গত ১২ এপ্রিল পাবনার চাটমোহরের ডায়মন্ড হোটেলের হলরুমে ‘চলনবিলের পরিবেশ সংকট ও সামাজিক আন্দোলন শীর্ষক’ এক আলোচনার আয়োজন করে। সভায় চাটমোহর সরকারি কলেজের ভূগোল বিষয়ের প্রভাষক ড. এস এম মুক্তি মাহমুদ তার প্রবন্ধে উপস্থাপন করেন, বর্তমানে চলনবিলের আয়তন মাত্র ৩৫০ বর্গকিলোমিটার। চার জেলার ১২ উপজেলার ৬২ ইউনিয়ন ও ৮টি পৌরসভা চলনবিলের অন্তর্ভুক্ত।
ড. এসএম মুক্তি মাহমুদের প্রবন্ধানুসারে গত প্রায় একশ বছরে চলনবিলের আয়তন কমেছে ১ হাজার বর্গকিলোমিটার। সর্বশেষ তথ্যের সঙ্গে তুলনা করলে ইম্পেরিয়াল গেজেট অব ইন্ডিয়ার তথ্যানুসারে, ১০৬ বছরে চলনবিলের আয়তন কমেছে ১ হাজার ৭৪ বর্গকিলোমিটার। ‘বাংলার ভ্রমণ’ গ্রন্থমতে, গত ৮৫ বছরে চলনবিলের আয়তন কমেছে ৭৯২ বর্গকিলোমিটার এবং অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আব্দুল হামিদের তথ্যানুসারে, ৫৮ বছরে চলনবিলের আয়তন কমেছে ১ হাজার ৭২২ বর্গকিলোমিটার। মতান্তর থাকলেও উপরোক্ত তথ্য বিশ্লেষণে চলনবিলের আয়তন যে ক্রমাগত কমছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
১৯৬৭ সালে প্রকাশিত অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ রচিত চলনবিলের ইতিকথা গ্রন্থসূত্রে জানা যায়, দুই হাজার বছর আগে চলনবিল নামে কোনো জলময় ভূভাগ ছিল না। তখন এ বিল ছিল সমুদ্রগর্ভে। কিছুকাল পর সমুদ্র চলনবিলকে জন্ম দিয়ে দক্ষিণে সরে যায়। পদ্মা ও যমুনা ধাত্রী রূপে শিশু চলনবিলকে ধারণ করে। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে চলনবিলের কোনো কোনো অঞ্চলে পলি জেগে ওঠায় লোকবসতি শুরু হয়। চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে গুপ্ত রাজাদের রাজত্বকালের নিদর্শন পাওয়া যায় চলনবিলে। বৌদ্ধ যুগে চলনবিল অঞ্চল পুণ্ড্রবর্ধন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অষ্টম শতাব্দীতে আদিশূরের রাজত্বকালে চলনবিল অঞ্চল গৌড় রাজ্যের ভর এলাকার অন্তর্ভুক্ত হয়। পাল ও সেন আমলে চলনবিল অঞ্চল বরেন্দ্র বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
লেখক প্রমথ নাথ বিশীর উদ্ধৃতি দিয়ে মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ তার এ গ্রন্থে লেখেন, ‘চারশত বছর পূর্বে চলনবিল রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়ার অধিকাংশ স্থানজুড়ে বিরাজ করত।’
এখন থেকে এক-দেড়শ বছর আগেও জনবসতি এলাকা ছাড়া চলনবিলের জলময় অংশের আয়তন ছিল ৫০০ বর্গমাইলের ওপরে। পাবনা, নাটোর, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়ার দক্ষিণাঞ্চল চলনবিলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্তমানে নাটোরের সিংড়া, গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম; পাবনা জেলার চাটমোহর ও ভাঙ্গুড়া এবং সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ ও সলঙ্গা— এ আটটি থানা এবং উল্লাপাড়ার দক্ষিণ-পশ্চিমের ১০টি ইউনিয়নজুড়ে চলনবিল অবস্থান করছে। ১৯১৪ সালে সাড়া-সিরাজগঞ্জ রেললাইন স্থাপিত হওয়ার পর এ রেললাইনের উত্তর-পশ্চিম অংশ চলনবিল নামে পরিচিত।
বাংলাদেশের বৃহৎ বিল চলনবিলের আয়তন কমার অন্যতম প্রধান কারণ নদিবাহিত পলি মাটি। নদীপথে প্রতি বছর ২২২ দশমিক ৫ মিলিয়ন ঘনফুট পলি চলনবিলে প্রবেশ করে। ৫৩ মিলিয়ন ঘনফুট পলি বিল থেকে বেরিয়ে যায়। প্রতি বছর ১৬৯ দশমিক ৫ মিলিয়ন ঘনফুট পলি বিলে জমা হয়। এ ছাড়া বিলের মধ্য দিয়ে সড়কপথ, রেলপথ নির্মাণ, ব্রিজ, কালভার্ট, স্লুইসগেট, ইটভাটা, বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, ময়লা-আবর্জনা জমে ও অবৈধ দখল ক্রমেই এক সময়ের চলন্ত বিল চলনবিলকে সংকুচিত করছে। এ এলাকার নদনদী, খাল-বিল, খাঁড়িও নাব্য হারিয়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে চলনবিল এলাকার প্রায় ৫০ লাখ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায়।
অতীতে এখানকার মানুষ কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, মৎস্য শিল্পসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চলনবিলের পানির ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু অধিকাংশ নদ-নদী এখন মৃতপ্রায়। এতে বিল, খাল, খাঁড়িও নাব্য হারিয়েছে। এ কারণে চলনবিল আজ মরা বিলে পরিণত হয়েছে। বিলের বিভিন্ন এলাকায় নির্মিত স্লুইসগেট একে নিয়ন্ত্রিত বিলে পরিণত করেছে।
এক সময় এসব নদী, বিল, খাল ও খাড়ির পানিতে শুষ্ক মৌসুমে সেচকাজ হতো। নৌযোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল। জমিতে ভালো ফসল উৎপাদন হতো। ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থাও ভালো ছিল। সড়কপথ হওয়ায় মানুষ সড়কপথে পণ্য পরিবহন করতে পারলেও তা ব্যয়বহুল। বর্তমান সময়ে চলনবিলের সব নদী বছরের অর্ধেকের বেশি সময় পানিশূন্য থাকে। এতে ব্যাহত হচ্ছে সেচকার্য, ফসল উৎপাদন। এরই মধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে অনেক ফসলের জাত।
মৎস্যভাণ্ডার খ্যাত চলনবিল আজ মাছশূন্য হওয়ার পথে। পানিস্বল্পতাসহ চায়না জাল, কারেন্ট জাল, স্বোতী জালসহ বিভিন্ন নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার বাড়ায় এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। খোদ চলনবিলের মানুষই ভুলতে বসেছে নদী, খাল, বিলের দেশি মাছের স্বাদ। খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়ায় বিলুপ্ত হচ্ছে জীববৈচিত্র্য, প্রাণপ্রকৃতি। বছরের অধিকাংশ সময় বেকার সময় কাটান এ এলাকার প্রায় ৭৫ হাজার জেলে। বাধ্য হয়ে এরই মধ্যে পেশা পরিবর্তন করেছেন অনেকেই।
‘চলনবিল রক্ষায় আমরা’র সমন্বয়কারী জাহাঙ্গীর আলম জানান, চলনবিলের আয়তন কমায় এর পরিবেশ সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করছে। পানির অভাবে চলনবিল এলাকার মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে নদী খনন না করায় পলি পড়ে নদীর তলদেশের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে নদীর পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে। ভূগর্ভস্থ পানির অতি ব্যবহারের কারণে পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। চলনবিল এলাকা ক্রমান্বয়ে মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চলনবিলের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সঠিক নিয়মে মৃতপ্রায় নদ-নদী খনন, নদীপথের প্রতিবন্ধকতা অপসারণ, দখল, দূষণ বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)-এর সদস্য সচিব শরীফ জামিল কালবেলাকে বলেন, চলনবিল যে শুধু স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বার্থে রক্ষা করা দরকার তা নয়, সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলকে লবণাক্ততার হাত থেকে রক্ষা করতে চলনবিলের নদ-নদী ও প্রাকৃতিক জলাশয় সংরক্ষণ করা জরুরি। সরকার এই অমূল্য সম্পদ স্থানীয় মানুষকে সঙ্গে নিয়ে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার কার্যকর উদ্যোগ না নিলে শিগগির চলনবিল অঞ্চলে মানবিক বিপর্যয় নেমে আসবে।
মন্তব্য করুন