সংসার চালাতে ন্যুব্জ শরীর নিয়ে ৩ যুগ ধরে গরু বা ঘোড়ার পরিবর্তে বুক দিয়ে তেলের ঘানি টেনে জীবনযাপন করছেন ষাটোর্ধ্ব মোস্তাকিন দম্পতি। নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার বাহাগিলি ইউনিয়নের উত্তর দুরাকুটি পাগলাটারী গ্রামের বাসিন্দা তারা।
জানা যায়, ৩ যুগ ধরে নিজ বাড়িতেই তেলের ঘানি টেনে ৩ ছেলে ও ৪ কন্যার ভরণপোষণ চালিয়ে আসছেন ষাটোর্ধ্ব এই দম্পতি। গরু বা ঘোড়া কেনার সামর্থ্য নেই বৃদ্ধ মোস্তাকিন (৬৮) ও তার স্ত্রী ছকিনার (৬৫)। দীর্ঘ সংসার জীবনে একমাত্র বাঁচার অবলম্বন তেলের ঘানির মাধ্যমে জীবনযাপন করায় গায়ের চামড়ায় ভাঁজ পড়ে বাঁকা হয়ে গেছে কোমর ও পিঠ। লক্ষ্য করে দেখা গেছে চোখেমুখে আতঙ্ক ও হতাশার ছাপ।
দারিদ্র্য এবং অবহেলা জর্জরিত এই মানুষটি কালবেলাকে বলেন, আমার মাথা গোছার ঠাঁই এর জায়গাটুকু ছাড়া আর কোনো ফসলের জমি নেই। গত ৪ বছর আগে আমার এই কঠিন জীবনযাপনের কথা পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পেলে নীলফামারীর সদরের এক দানবীর ব্যক্তি তার খামার থেকে আমাকে ১টি গরু দান করেছিলেন। ২ বছর লালনপালন করার পর একটি বাছুরও জন্মেছিল। আনন্দে আমার বুকটা ভরে উঠেছিল কিন্তু কপালে আমার সুখ সয় নাই। গাভির দুধের বাটনে পচন ধরেছিল বেহাল অবস্থা দেখে স্থানীয় কসাইয়ের কাছে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছি।
তিনি আরও জানান, আমার ৩ ছেলে ৪ কন্যা। প্রথম ছেলে হোটেল শ্রমিক, দ্বিতীয় ছেলে অসুস্থ ও তার দুই ঘাড়ে টিউমার। আর তৃতীয় ছেলে প্রতিবন্ধী চোখে দেখে না। ৪ কন্যার বিয়ে দিয়েছি তার মধ্যেও তৃতীয় কন্যা যৌতুকের দায়ে তার একটি পুত্রসন্তানসহ ৩ থেকে ৪ বছর ধরে আমার বাড়িতে।
স্ত্রী ছকিনা কালবেলাকে বলেন, আমার এই বৃদ্ধ স্বামী জীবন বাঁচার তাগিদে প্রতিদিন সকালে এক অবর্ণনীয় ঘূর্ণায়মান জীবনযুদ্ধে নেমে হেঁটে গ্রামে গ্রামে সরিষা সংগ্রহের কাজে বের হয়ে যান। সরিষা সংগ্রহ শেষান্তে বাড়িতে ফিরে বিরামহীনভাবে তেলের ঘানি টানার কাজ করেন বিকাল ৩টা পর্যন্ত। এতে ৫ কেজি সরিষার দানা পিষে সোয়া লিটার তেল ও ৩ কেজির মতো খৈল বের করেন। এতে তার প্রতিদিন আয় আসে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। এতে খাওয়া তো দূরের কথা শরীরের ঘাম শুকাতে না শুকাতে তেল ও খৈল বিক্রির জন্য ছুটে যেতে হয় হাটবাজারে।
স্থানীয় বাসিন্দা জিয়াউর রহমান বলেন, মোস্তাকিন তেলির খাওয়া পড়ার যেমন অভাব ঠিক তেমনি রাতে শোয়ার ঘরেরও অভাব স্ত্রী ছেলেমেয়ে ও ছেলের বউসহ যে ঘরে থাকে সেই ঘরের ওপরে রোদবৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পলিথিন দিয়ে বসবাস করছে।
প্রতিবেশী শরিকুল ইসলাম জানান, মোস্তাকিন বসতভিটার উঠানে জোড়াতালির টিনের ছাপরায় গাছের গুঁড়ি ও পাথর দিয়ে তৈরি করেছেন তেলের ঘানি। গরু বা ঘোড়া না থাকায় ঘানি টানার কাজ এই বৃদ্ধ দম্পতি বুক-হাত দিয়ে টেনে কোমর ও পিঠে ভাঁজ ফেলাইছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের আধুনিকতার ছোঁয়াকে হার মানিয়ে এখনো আদিম সভ্যতার আদলে দারিদ্র্য অবহেলা জর্জরিত এই ষাটোর্ধ্ব দম্পতি কঠিন এক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, সহানুভূতি ও মানবিক সহযোগিতা পেলে হয়ত এই বৃদ্ধ বয়সে জীবন সায়াহ্নে একটু স্বস্তিতে পরিবার নিয়ে বাঁচতে পারবে।
এ বিষয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুজাউদৌল্লা লিপটন বলেন, উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে তাকে সহযোগিতা করা হবে।
অভাবগ্রস্ত মোস্তাকিন দম্পতির বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রীতম সাহা বলেন, আমি শুনেছি পরিবারটির ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে সহযোগিতা করা হবে।
মন্তব্য করুন