ফুলের প্রতি মানুষের ভালোবাসা অনাদিকালের। আর ফুল যদি হয় ঘ্রাণময় তবে তো কথাই নেই। ফুল প্রকৃতিকে সুসজ্জিত করার পাশাপাশি সুঘ্রাণ দিয়ে প্রকৃতিকে মোহনীয় করে তোলে। মোহনীয় ঘ্রাণের এমনই এক ফুল ছাতিম।
কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার প্রকৃতিকে মাতিয়ে তুলেছে এ ফুলের সৌন্দর্য ও মোহনীয় ঘ্রাণ। আকৃষ্ট করছে সব বয়সী মানুষকে। এ ফুল ভিন্নতর বৈশিষ্ট্যের ঘ্রাণের জন্যই বিখ্যাত ও বেশ পরিচিত। সন্ধ্যা নামলেই এ ফুলের তীব্র ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে পরিবেশ। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ফুলের ঘ্রাণ যেন পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে।
ছাতিম মূলত হেমন্তের ফুল। তবে শরতের শেষের দিক থেকেই প্রকৃতিতে এ ফুল ফুটতে শুরু করে। আর সব ফুল থেকে এ ফুলের ঘ্রাণ সম্পূর্ণ আলাদা ও মোহনীয় হওয়ায় সহজেই আকৃষ্ট করে মানুষকে। মোহনীয় এ ফুলের মাদকতায় বিমুগ্ধ না হওয়ার উপায় নেই। দিনের বেলায় এ ফুল যদি কোনো কারণে চোখে নাও পড়ে তবে রাতে তীব্র মিষ্টি ঘ্রাণ জানিয়ে দেয় আশপাশে কোথাও ছাতিম ফুল ফুটেছে। ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ নাকে এসে পৌঁছালেই বোঝা যায় প্রকৃতিতে হেমন্ত আসছে বা এসেছে।
ইউনানি চিকিৎসকদের তথ্যমতে, ছাতিমগাছ শুধু ফুল ও ফুলের সুগন্ধ দিয়ে প্রকৃতিকে মাতিয়ে রাখে না, এর রয়েছে নানা ঔষধি গুণ। জ্বর উপশম, দীর্ঘস্থায়ী পাতলা পায়খানা ও আমাশয় নিরাময়ে, চর্মরোগের চিকিৎসায়, রক্তচাপ কমানোসহ আরও নানা রোগ নিরাময় ও উপশমে এ গাছের বাকল, পাতা ও কষ ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়াও এ গাছের ছাল থেকে তৈরি ক্বাথ ম্যালেরিয়া বা টাইফয়েডের মতো জ্বর নিরাময়ে বিশেষভাবে কার্যকর।
জানা গেছে, ছাতিম অ্যাপোসাইনেসি বর্গের অন্তর্ভুক্ত বহুবর্ষজীবী সপুষ্পক উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম অ্যালস্টনিয়া স্কলাররিস। এর ইংরেজি নাম ডেভিলস ট্রি বা ব্ল্যাকবোর্ড ট্রি। এটিকে বাংলায় ছাতিম, ছাতিয়ান, ছাতইন, ছাইত্যান নামে ডাকা হয়। এটির সংস্কৃত নাম সপ্তপর্ণী। এর আদি নিবাস ভারতীয় উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়।
এটি আর্দ্র কর্দমাক্ত জলসিক্ত সানসহ সর্বত্র জন্মে। ছাতিমগাছের মূলাবর্তে সাতটি পাতা একসঙ্গে থাকে, আর এর অগ্রভাগে গুচ্ছ গুচ্ছ হালকা ঘিয়ে রঙের ফুল আসে। এ গাছটি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য উদ্ভিদ। এরা যে কোনো পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে।
ছাতিমগাছ ২০ থেকে ৪০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এর পাতা ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। এর পাতা উপরের দিকটা চকচকে আর নিচের দিকটা ধূসর রঙের। একাধিক শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট গাছটির ছাল অসমতল ও ধূসর। এই গাছের কাঠ ব্ল্যাকবোর্ড ও পেনসিল তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। এ গাছের কাঠ দিয়ে কফিন তৈরি করা হয়। এ ছাড়া ছাতিমগাছের ঔষধি গুণাগুণ রয়েছে। ছাতিমগাছের পরিবেশের জন্য বেশ উপকারী। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এ গাছের ভূমিকা অপরিসীম। তবে প্রকৃতি থেকে দিন দিন ছাতিমগাছের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আশিকুর রহমান বলেন, ব্রাহ্মণপাড়া থেকে কুমিল্লা যাওয়ার পথে হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ে ছাতিমগাছ। এ সময়টায় এসব গাছে ফুল ফুটেছে। তবে দিনের বেলায় ছাতিম গাছগুলোর ফুল দেখে মুগ্ধ হই, আর সন্ধ্যার পর কখনো এ পথে আসা-যাওয়া হলে ফুলের গন্ধে মন ভরে যায়। মুরব্বিদের কাছ থেকে শুনেছি এক সময় এই উপজেলায় অনেক ছাতিমগাছ ছিল।
আরেক স্থানীয় বাসিন্দা হাবিবুর রহমান বলেন, এক সময় গ্রামগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় ছাতিম গাছ দেখা যেত। ফুল ফুটলে এসব ফুলের গন্ধে মন জুড়িয়ে যেত। তবে এ উপজেলার প্রকৃতি থেকে ছাতিমগাছ কমে যাচ্ছে। এখন আর যত্রতত্র আগের মতো এ ফুলের গন্ধ নাকে আসে না। তবে আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের সামনে একটি ছাতিমগাছ রয়েছে। মাগরিবের নামাজের পর থেকেই এই ফুলের গন্ধ আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে।
ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী ফারিয়া বিনতে আবিদা বলেন, ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ মন কেড়ে নেওয়ার মতো আকর্ষণীয়। একটি ছাতিমগাছে ফুল এলে সে ফুলের ঘ্রাণ অনেকটা এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। রাত যত বাড়ে ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ ততটাই তীব্র হয়। আমাদের বাড়ির পেছনের পুকুরের পাড়ে একটি ছাতিমগাছ রয়েছে। প্রতিবছরই এ ফুলের ঘ্রাণ আমরা উপভোগ করি। বলতে গেলে প্রতিবছর এ ফুলের ঘ্রাণের অপেক্ষায় থাকি।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হুমায়ুন কবির বলেন, ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ মানুষকে এতটাই প্রভাবিত করে যে মানুষ এ ফুলের ঘ্রাণে ডুবে যায়। ফুলের সৌন্দর্যের চেয়ে এ ফুলের ঘ্রাণই মানুষকে আকৃষ্ট করে। ছাতিমগাছ উঁচু হয় বলে খুব কাছ থেকে এর ফুল কম দেখার সুযোগ হয়। ছাতিমগাছে ফুল এলে মনে হবে যেন পুরো গাছজুড়ে কেউ অসংখ্য ফুলের স্তবক তৈরি করে রেখেছে। ছাতিমগাছের উপরিভাগ অনেকটা খোলা ছাতার মতো।
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইউনানি চিকিৎসক ডা. সোহেল রানা কালবেলাকে বলেন, ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এজন্য সন্ধ্যার পর থেকে কোথাও ছাতিমগাছ চোখে না পড়লেও এর তীব্র ঘ্রাণ নাকে এসে জানিয়ে দেয় আশপাশে ফুটেছে ছাতিম ফুল। অন্যান্য ফুলের ঘ্রাণ থেকে এই ফুলের ঘ্রাণ পুরোপুরি ভিন্ন এবং আকর্ষণীয়।
তিনি আরও বলেন, এ গাছ শুধু ফুল ও ফুলের ঘ্রাণের জন্যই বিখ্যাত নয়, গাছের বিভিন্ন অংশ নানা রোগের ভেষজ ওষুধ হিসেবে ব্যবহারের জন্য বেশ পরিচিত। তবে দিন দিন প্রকৃতি থেকে এই গাছটির উপস্থিতি হ্রাস পাচ্ছে। এতে মনভোলানো ঘ্রাণের মতো ফুলে স্বল্পতার পাশাপাশি ভেষজ চিকিৎসা ব্যবস্থায় অপ্রতুলতার সৃষ্টি হচ্ছে।
মন্তব্য করুন