বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ৪ আগস্ট দুপুর সাড়ে ৩টার দিকে শেরপুরে ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়িচাপায় নিহত হয় স্থানীয় কলেজশিক্ষার্থী মো. মাহবুব আলম (১৯)। সেই মামলায় আসামি করা হয়েছে ঢাকার দুই ব্যক্তিকে। শেরপুরে যখন এই হত্যার ঘটনা ঘটে তখন তারা দুজনেই ঢাকার উত্তরায় অবস্থান করছিলেন।
কালবেলার হাতে আসা একটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজে একজনের ঢাকায় অবস্থানের চিত্র দেখা গেছে। অপরজনও সেদিন ছিলেন নিজ বাসাতেই।
আসামির তালিকায় থাকা ব্যক্তিরা কোনো রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত নন। তারা বিগত এক দশকে কোনো দিনই শেরপুর জেলায় যাননি। এমনকি মামলার বাদীও আসামিদের চেনেন না।
মামলার সংশোধিত এজাহারে ৬৪ নম্বর আসামি হিসেবে যার নাম রয়েছে তিনি হলেন- ইলিয়াস হোসাইন (৪০)। তিনি একজন ব্যবসায়ী। তার গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে।
এ ছাড়া একই মামলায় ৬৫ নম্বর আসামি করা হয়েছে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার ফরহাদ হোসেনকে (৩৮)। ফরহাদের গ্রামের বাড়ি পাবনার সুজানগরে। তারা দুজনেই বর্তমানে উত্তরায় বসবাস করছেন।
দুইজন ভিন্ন জেলার মানুষ কিভাবে শেরপুরে ছাত্র হত্যার আসামি হলেন তা নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা।
সূত্র বলছে, বিশেষ কোনো ব্যক্তির ইশারায় বা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে এ মামলায় মনগড়া আসামি করা হয়েছে ওই দুজনকে।
কলেজশিক্ষার্থী মাহবুব আলম হত্যার ঘটনায় প্রথমে ১২ আগস্ট স্থানীয় থানায় মামলা দায়ের করেন মাহবুবের মা মাহফুজা বেগম। ওই মামলার এজাহারে শেরপুর-১ আসনের সাবেক এমপি মো. ছানোয়ার হোসেন ছানু এবং শেরপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. হুমায়ুন কবির রোমানের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৩০০-৪০০ জনকে অভিযুক্ত করেন বাদী। কিন্তু ১৯ আগস্ট একটি সংশোধিত এজাহার দেওয়া হয়। সেখানে ৮১ জনের নাম ‘আসামি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পুলিশের সেই এজাহারে ভিডিও ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শী লোকজনের সঙ্গে কথা বলে ৮১ জনকে মামলায় আসামি হিসেবে সংযোজন করার আবেদন করা হয়।
তবে মামলার বাদি মাহফুজা বেগম কালবেলাকে বলছেন, আসামিদের কাউকেই চেনেন না তিনি। এসব মানুষের নাম কারা দিয়েছে তাও জানা নেই তার।
শেরপুরের কলেজশিক্ষার্থী মাহবুব হত্যার একটি ভিডিও ফুটেজ রয়েছে কালবেলার হাতে। ওই ভিডিও ফুটেজ দেখা যায়, ৪ আগস্ট, দুপুর সাড়ে তিন টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের মিছিলের ভেতর দিয়ে দ্রুত গতির একটি গাড়ি একাধিক ছাত্রকে চাপা দিয়ে চলে যায়।
সদর উপজেলার এসিল্যান্ডের এই সাদা গাড়িতে চাপা পড়ে আন্দোলনরত দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে একজন হলেন- শেরপুর সরকারী কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র ও তরুণ মাহবুব আলম।
মাহবুব হত্যা মামলার এজাহারে অনুযায়ী, ৪ আগস্ট দুপুর ৩টা ৪৫ মিনিটে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটেছে। সেই সময়ে আসামিরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।
কালবেলার হাতে থাকা একটি সিসি ক্যামেরা ফুটেজে দেখা যায়, মামলার ৬৪ নম্বর আসামি ইলিয়াস হোসাইন ঘটনার দিন উত্তরায় দুপুর ৩টা ৩৮ মিনিট ৪৯ সেকেন্ডে একটি লিফট থেকে বেরিয়ে তার এক বন্ধু অফিসে প্রবেশ করছেন। এরপর সেই অফিসের ভেতরেই তিনি অবস্থান করছিলেন। অফিসের ভেতরে থাকা সিসি ক্যামেরায় তাকে একাধিকবার হাঁটাচলা করতে দেখা গেছে।
উত্তরায় থাকা দুজন মানুষ কীভাবে শেরপুরে ছাত্র হত্যার আসামি হলেন তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে শেরপুরের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র রয়েছে কি না জানতে চাইলে ফরহাদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের এক বন্ধুর বাড়ি শেরপুরে। তার নাম এস এম সোহেল রানা। সে একসময় আমার সঙ্গে ব্যবসা করত। তার সঙ্গে বহু বছর আগে একটা ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে আর কোনো যোগাযোগ নেই। আমার ধারণা সে হয়তো কাউকে ম্যানেজ করে মামলায় ফাঁসাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু এটা শুধুই আমার ধারণা এটার কোনো প্রমাণ নেই আমার কাছে। এমনটা ঘটতেও পারে আবার নাও পারে। এটা অন্য কারও চক্রান্ত হতে পারে।’
ফরহাদ হোসেন ও ইলিয়াস হোসাইনের অভিযোগে সূত্র ধরে যোগাযোগ করা হয় তাদের সেই পুরনো বন্ধু এস এম সোহেল রানার সঙ্গে। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘মামলার সঙ্গে আমার কোনো রকমের সংশ্লিষ্টতা নেই। আমার সঙ্গে আমার বন্ধু ফরহাদের পুরনো একটা ব্যবসায়িক ঝামেলা ছিল। কিন্তু সে কারণে মামলায় তার নাম দেওয়ার মতো কাজ আমি করি নাই। কোনো তৃতীয় পক্ষ এখানে ঢুকে এই কাজ করেছে।’
ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থাকা সত্ত্বেও কীভাবে দুজনকে আসামি করা হলো জানতে চাইলে নিহতের ভাই মাজহারুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘এটা পুলিশ বলতে পারবে, আমরা আগে কোনো দিনই থানায় যাই নাই। আইনের ফাঁকফোকর সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নাই। আমরা সহজ সরল মানুষ এসব বুঝি না। কীভাবে কি করল এটা পুলিশই বলতে পারবে আমরা তাদেরকে (আসামিদের) চিনিও না।’
নিহত আলমের মা মাহফুজা বেগম চোখের পানি যেন থামছেই না। প্রতিবন্ধী বাবাসহ চার সদস্যের পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম কলেজ শিক্ষার্থী মাহবুবের মৃত্যুতে স্থবির গোটা পরিবার। ফ্রিল্যান্সিং করে মায়ের জন্য নতুন ঘর বানানোর ইট কিনেছিলেন তিনি। ছোট বোনকে কথা দিয়েছিলেন পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ বানাবেন।
মাহফুজা বেগম কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা ভিডিওতে দেখছি ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ি আমার ছেলেরে মাইরা ফেলাইছে। বিনা অপরাধে কেন আমার ছেলেরে হত্যা করল। ওই গাড়িতে যারা ছিল তারাই হত্যাকারী, তাদের শাস্তি চাই। আসল হত্যাকারী যারা তাদের সকলের বিচার চাই।’
মাহবুবের পরিবারের অন্য সদস্যরা বলছেন, মামলায় যেন প্রকৃত দোষির শাস্তি হয়। কোনো নির্দোষ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হন।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘জুলাই-আগস্টে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলোতে যে মামলা দায়ের করা হয়েছে, অনেক মামলায় দেখা গেছে এসব মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তারা ঘটনাস্থলে ছিলেন না। কিংবা অনেকে সেই জেলার বাসিন্দাও নন। এমন ব্যক্তিদের নাম ওই সব মামলায় দেওয়া হলে আইনগতভাবে সে মামলার মেরিট বা ভিত্তিটা কমে যায়। অবশ্যই ছাত্র-জনতা হত্যার বিচার করা উচিত। যারা প্রকৃত অপরাধী তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে আসামি করা মোটেও কাম্য নয়। অতীতেও আমরা দেখেছি এমন ঘটনায় পুলিশের মামলা বাণিজ্য। সেই রকমের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে। পুলিশের আগের যে অভ্যাস ছিল সেটির কতটা পরিবর্তন হলো?
ঢাকায় থাকা ব্যক্তিদের কী কারণে আসামি করা হয়েছে জানতে চাইলে শেরপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম কালবেলাকে বলেন, ‘এটা তো তদন্তাধীন বিষয়। বাদী বলতে পারবে কেন তাদের আসামি করা হয়েছে।’
কিন্তু বাদী বলেছে আসামি তালিকা পুলিশ করেছে এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, ‘বাদী তো এজাহার সংশোধনের জন্য আবেদন করেছে কোর্টে। কারা কারা আসামি এটা বাদী বা বাদীর লোকজন যারা রয়েছে তারাই বলতে পারবে।’
এ বিষয়ে শেরপুর পুলিশ সুপার আমিনুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘আসামির নাম আসতেই পারে, কেউ শত্রুতাবশত নাম দিতে পারে। মামলায় আসামির নাম আসলেই তো ফাঁসি হয়ে গেছে বিষয়টা এমন না। আসামির তালিকায় নাম আসতেই পারে। এটা হতেই পারে। কিন্তু আমাদের তদন্তের কাজ এখনো বাকি আছে। তদন্তে তো এসব বের হয়ে আসবে। যদি আসামি এখানে উপস্থিত না থাকে এবং আক্রোশমূলক তাকে দেওয়া হয় তাহলে চার্জশিট থেকে তার নাম অবশ্যই বাদ যাবে।’
মন্তব্য করুন