ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দু এবং এটি কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়; বরং এটি সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক (মুক্ত বুদ্ধি চর্চার) বিকাশ কেন্দ্র বা প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী, ধর্ম বর্ণ, কৃষ্টি-কালচার একাকার হয়েছে এই চত্বরে।
বৈচিত্র্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত সৌন্দর্য বা স্বকীয়তায় অনন্য। সব বৈচিত্র্যকে ছাড়িয়ে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ যেমন গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বামপন্থি রাজনীতি ও ডানপন্থি রাজনীতি চর্চার সুযোগ রয়েছে এই পবিত্র ভূমিতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্রনেতাদের স্বপ্ন ধৃষ্টতা এনে দিয়েছিল এক নতুন সূর্য—স্বাধীনতা তার নাম। এই পবিত্র ভূমি থেকে অতীতের যেসব গণআন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা সফলও হয়েছিল।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সর্বশেষ ’২৪-এর জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে হাসিনার পতন এদেশে আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রদের ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ঐতিহাসিকভাবে দেশের প্রতিটি ন্যায়সংগত গণআন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সব জাতীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা।
‘মানুষ জন্মগতভাবে রাজনৈতিক জীব’ গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের এই মতবাদ বাংলাদেশের জনগণের জন্য সর্বোচ্চ প্রযোজ্য, কারণ এ দেশের জনগণ অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন। আমরা দেখেছি প্রতিটি গণআন্দোলনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বুকের তাজা রক্ত দিয়েছেন, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত।
১৯২২ সালের ডিসেম্বরে কার্জন হল থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ১৯২৩/২৪ বর্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন হবে, এটা ছিল ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের প্রথম পদক্ষেপ। বাংলাদেশে মুক্ত গণতান্ত্রিক চর্চা ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সূতিকাগার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদকে (ডাকসু) বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
গত দেড় দশকে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শাসনের ফলে দেশে যে দুঃশাসন চলছিল তারই অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির সংস্কৃতি চালু করে। ছাত্ররাজনীতির মূলধারার বাইরে গিয়ে আওয়ামী লীগের পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত হয় সংগঠনটি। ভিন্নমত ও দর্শন দমনে চরম নৃশংস হয়ে ওঠে তারা। তাদের চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিকৃষ্ট উদাহরণ বুয়েটের আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড।
প্রতিটি ছাত্র সংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ভীতিকর অনুভূতির সৃষ্টি করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হারাতে থাকে তার সাধারণ শিক্ষার পরিবেশ। দেশে আওয়ামী লীগের দুঃশাসন ও নৃশংসতার প্রতিচ্ছবিতে পরিণত হয় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ, আর এই নৃশংসতার শিকার হয় বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ হলগুলোতে গেস্ট রুম নির্যাতন, সিট বাণিজ্য ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে ক্যান্টিনগুলোর খাবারের মান ধ্বংস করে। নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ এই কাজগুলো করেছিল পতিত স্বৈরাচার সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্লিপ্ততাই ও চরম আবাসিক সংকটের কারণে।
আমাদের প্রাণের দাবি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের উচ্ছৃঙ্খল, বেপরোয়া, ভয়ানক, নৃশংস আচরণ যেন আর অন্য কোনো ছাত্রসংগঠন কায়েম করতে না পারে। হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হলো। মাথাব্যথা হয়েছে বলে মাথা কেটে ফেলতে হবে এমন সিদ্ধান্ত, এটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। মুক্তচিন্তার চারণভূমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি থাকবে, থাকতে হবে নেতৃত্ব বিকাশের জন্য, থাকতে হবে আগামীর মানবিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরি করার আঁতুড়ঘর। সেক্ষেত্রে নেতৃত্ব তৈরির পাওয়ার হাউস হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোকে চিহ্নিত করা হয়।
(লেখক : সাবেক সহসভাপতি, ছাত্রদল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
মন্তব্য করুন