মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত রাখাইন রাজ্য। এটি বহু বছর ধরে জাতিগত বৈষম্য, সামরিক নিপীড়ন ও রাজনৈতিক অবহেলার শিকার হয়ে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মির শক্তিশালী উত্থান হয়েছে। তারা রাখাইনের ভূমি দখল করছে। তারা শুধু সফল সামরিক অভিযানই চালাচ্ছে না, ক্রমে একটি ‘ডি ফ্যাক্টো’ প্রশাসন গড়ে তুলছে। এতে প্রশ্ন উঠেছে—রাখাইন কি সত্যিই স্বাধীনতার পথে এগোচ্ছে? রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতি, আরাকান আর্মির উত্থান, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক প্রভাব এবং বাংলাদেশের কৌশলগত উদ্বেগ নিয়ে করা হয়েছে এ প্রতিবেদন।
আরাকান আর্মি: রাষ্ট্র গঠনের পথে
২০০৯ সালে কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মির (কেআইএ) ছত্রছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া আরাকান আর্মি শুরুতে উত্তর মিয়ানমারের কাচিন অঞ্চলে প্রশিক্ষণ নিলেও ২০১৫ সাল থেকে রাখাইনে সক্রিয় লড়াই শুরু করে। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর সারাদেশে যখন রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে, তখন থেকেই এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী রাখাইনে দ্রুত বিস্তার লাভ করে এবং বর্তমানে তারা অনেক এলাকার কার্যত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।
২০২৪ সালের শুরুতে আরাকান আর্মি ঘোষণা দেয়, তারা ‘স্বশাসিত আরাকান প্রশাসন’ পরিচালনা করছে। স্থানীয় সংবাদ ও পর্যবেক্ষকদের মতে, মাউন্দো, মিনবিয়া, পলেটওয়া ও বুথিডংসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় তারা এখন নিজস্ব পুলিশ, কর আদায়, স্থানীয় বিচারব্যবস্থা ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ পরিচালনা করছে। তারা নিজস্ব পতাকা ও পোশাকধারী কর্মীদের দিয়ে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালাচ্ছে, যারা মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো নির্দেশনা মানছে না।
এ পরিস্থিতিকে অনেকেই একটি ‘ডি ফ্যাক্টো স্টেট’—হিসেবে দেখছেন। যখন কোনো অঞ্চল সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে এমনকি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ছাড়াই স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করে, মূলত তা থেকেই ডি ফ্যাক্টো স্টেটের ধারণাটি এসেছে।
ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব: কার লাভ, কার ক্ষতি
রাখাইন কেবল একটি সীমান্ত রাজ্য নয়, এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক চৌকস অঞ্চল। বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী এ অঞ্চলে চীন নির্মাণ করছে গভীর সমুদ্রবন্দর কিয়াকপিউ, রয়েছে চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর (সিএমইসি)-এর তেল ও গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প। এই করিডোর চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের’ (বিআরআই) অংশ হিসেবে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তবে যদি আরাকান আর্মি এই অঞ্চল পুরোপুরি দখল করে নেয়, তাহলে চীনের কোটি কোটি ডলারের বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়বে। যদিও অনেকেই বলছেন, চীন তার স্বার্থরক্ষায় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ রেখে চলে। আরাকান আর্মির কিছু কূটনৈতিক বার্তায় চীনের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে। তাই ধারণা করা হচ্ছে, চীন আরাকান আর্মির ডি ফ্যাক্টো প্রশাসন মেনে নিতে পারে—যদি তাদের অর্থনৈতিক প্রকল্পগুলো নিরাপদ থাকে।
এদিকে ভারতও এই অঞ্চল নিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত। সিলিগুড়ি করিডোর (চিকেন নেক) তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একমাত্র সংযোগস্থল হওয়ায়, ভারতের বিকল্প রুট প্রয়োজন। রাখাইনে তাদের কালাদান প্রকল্প রয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশের ভূখণ্ড হয়ে বিকল্প করিডোর তৈরির বিষয়ে ভারত আগ্রহী——যাতে পণ্য, সেনা ও রসদ দ্রুত পৌঁছানো যায়। একইসঙ্গে চীনা প্রভাব মোকাবিলা করা যায়। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
একইসঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলেও রাখাইন রাজ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। মানবিক সহায়তার নামে তারা রাখাইনে ‘মানবিক করিডোর’ স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে, যা পরোক্ষভাবে চীনা প্রভাব হ্রাস করার কৌশল হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তা সংকট
বাংলাদেশের জন্য রাখাইন রাজ্য বরাবরই স্পর্শকাতর। এই রাজ্য থেকেই শুরু হয়েছে রোহিঙ্গা সংকট, যার ফলে বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে চলমান সংঘর্ষের ফলে সীমান্ত এলাকায় গোলাবর্ষণ, ড্রোন হামলা, এমনকি বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের মার্চ-এপ্রিলে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ ও সেনারা সীমান্ত লঙ্ঘন করে ঢুকে পড়ে, যা বিজিবি পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখালেও বাংলাদেশের জন্য এটি নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
মানবিক করিডোরের নামে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো ‘প্রক্সি ওয়ারে’ জড়াবে না বাংলাদেশ; বরং এ নিয়ে যা প্রচার করা হচ্ছে, তা নিছকই অপতথ্য ও গুজব
আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের ‘আরাকানবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের নিজেদের দলে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টায় রয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, রোহিঙ্গা তরুণরা আরাকান আর্মিতে যোগ দিচ্ছে। এটি বাংলাদেশের জন্য জটিল সংকট তৈরি করছে। কারণ একদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান, অন্যদিকে প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
রাখাইন কি সত্যিই স্বাধীন হতে যাচ্ছে?
যদিও আরাকান আর্মির নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করেননি, তারা বারবার নিজেদের ‘আরাকান জাতি’র স্বশাসিত এলাকা গঠনের কথা বলছেন। তাদের ভাষায়, ‘আমরা এমন একটি সরকার ও সেনাবাহিনী গঠন করছি, যা রাখাইন জনগণের স্বার্থে কাজ করবে।’ তবে স্বাধীনতা অর্জনের পথ মোটেও সহজ নয়। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে হলে জাতিসংঘের অনুমোদন, আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর স্বীকৃতি ও কৌশলগত সমর্থন প্রয়োজন।
কিন্তু মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনকে তাদের ভূখণ্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করে। যে কোনো মূল্যে এটি মিয়ানমার হাতছাড়া করবে না। একইভাবে চীন, ভারত ও বাংলাদেশ কেউই রাখাইনে একটি নতুন রাষ্ট্রের উত্থান চায় না, কারণ তা পুরো অঞ্চলেই নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক ভারসাম্যকে প্রভাবিত করবে।
আন্তর্জাতিক আইন ও বাস্তবতা
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, ‘স্বশাসনের অধিকার’ থাকলেও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের স্বীকৃতি এবং অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রয়োজন। আরাকান আর্মির বর্তমান অবস্থান এ পর্যায়ে না পৌঁছালেও তারা যেভাবে প্রশাসন ও সশস্ত্র বাহিনী পরিচালনা করছে, তা কুর্দিস্তান, দোনবাস, কারাবাখ অঞ্চলের ‘ডি ফ্যাক্টো স্টেট’-এর সঙ্গে তুলনা করা যায়।
এ ধরনের গোষ্ঠীগুলো মাঝে মাঝে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে অংশগ্রহণ করে, সীমিত পরিসরে বাণিজ্য চালায়, এমনকি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সঙ্গে কাজ করে। আরাকান আর্মি এই পথে হাঁটছে কি না, তা এখনও পরিষ্কার নয়, তবে তাদের বর্তমান কর্মকাণ্ড সেদিকেই ইঙ্গিত করে।
কঠিন প্যারাডক্সে বাংলাদেশ
বাংলাদেশ এখন এক জটিল কৌশলগত দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেছে। একদিকে, মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা থাকে, অন্যদিকে আরাকান আর্মিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলে সীমান্ত নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ হয়তো ‘দ্বৈত নীতির’ পথে হাঁটতে বাধ্য হবে। একদিকে প্রকাশ্যে মিয়ানমার সরকার, অন্যদিকে সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশ চাইলে জাতিসংঘ ও আসিয়ানের মাধ্যমে রাখাইন ইস্যুতে মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি চীনের সঙ্গে কৌশলগত আলোচনা জরুরি, যাতে সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে সমঝোতা হয়।
জাতিসংঘ রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে বাংলাদেশ হয়ে একটি ‘মানবিক করিডোর’ স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে। যদিও বাংলাদেশ সরকার নীতিগতভাবে সম্মত হলেও, এ বিষয়ে এখনো কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। অনেকে আশঙ্কা করছেন, এটি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পরিবর্তে এক ধরনের স্থায়ী সমাধান হয়ে উঠতে পারে, যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও জনসংখ্যাগত ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘মানবিক করিডোর নিয়ে সরকার এখনো কোনো চুক্তি করেনি। এটি কেবল আলোচনা পর্যায়ে আছে।’
তিনি বলেন, মানবিক করিডোরের নামে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো ‘প্রক্সি ওয়ারে’ জড়াবে না বাংলাদেশ; বরং এ নিয়ে যা প্রচার করা হচ্ছে, তা নিছকই অপতথ্য ও গুজব।
রাখাইনে ‘মানবিক করিডোর’ বিষয়ে বিতর্কের প্রসঙ্গ টেনে খলিলুর রহমান আরও বলেন, ‘এটা মানবিক করিডোর নয়। তারা রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে চ্যানেলের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। আর মানবিক করিডোর ও চ্যানেল এক নয়। এমন কিছু (চ্যানেল) হলে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে তা পরিচালিত হওয়ার কথা। এর মাধ্যমে ত্রাণ ও খাদ্য যাবে।’
নতুন বাস্তবতা
রাখাইন এখন শুধু মিয়ানমারের সীমান্ত রাজ্য নয়, বরং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনৈতিক ‘হটস্পট’। আরাকান আর্মির দখল, ডি ফ্যাক্টো প্রশাসনের গঠন, বৈশ্বিক শক্তির নজর এবং বাংলাদেশের সীমান্ত হুমকি—সবকিছু মিলিয়ে রাখাইন একটি নতুন সংকটের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
রাখাইন সত্যিই স্বাধীন হবে কিনা, নাকি এটি আরও একটি ‘ফ্রোজেন কনফ্লিক্ট’-এর মত জটিলতায় আটকে থাকবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে বাংলাদেশের জন্য এটি নিছক মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ইস্যু নয়—বরং বাংলাদেশের নিরাপত্তা, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও কৌশলগত ভারসাম্যের ক্ষেত্রে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মন্তব্য করুন