ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধ বন্ধে প্রথমবারের মতো সুনির্দিষ্টভাবে একটি পরিকল্পনা প্রস্তাব তুলে ধরেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ৩ পর্যায়ে যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নের এই প্রস্তাবে ইসরায়েল সম্মত হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। নতুন এই প্রস্তাব মেনে নিতে হামাসের প্রতি আহ্বান জানিয়ে জো বাইডেন বলেছেন, ‘এ যুদ্ধ শেষ হওয়ার সময় এসেছে’।
স্থানীয় সময় গতকাল শুক্রবার হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের সামনে এক ভাষণে নতুন এই প্রস্তাব তুলে ধরেন জো বাইডেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, তিন পর্যায়ের নতুন এই প্রস্তাবে গাজায় পুরোপুরি যুদ্ধবিরতি কার্যকরের সুযোগ রয়েছে। এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।
হামাসের উদ্দেশে বাইডেন বলেন, ‘হামাস সবসময় বলে থাকে, তারা যুদ্ধবিরতি চায়। এখন হামাসের সামনে প্রমাণ করার সুযোগ এসেছে যে, তারা আসলেই এটা চায় কি না’।
নতুন প্রস্তাবে যা আছে:
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিন পর্বের এই প্রস্তাবের শুরুতে ছয় সপ্তাহের জন্য যুদ্ধ বিরতির কথা বলেছে ইসরায়েল। এটি হবে যুদ্ধ বিরতির প্রথম পর্যায়। এ সময়ে গাজার সব জনবহুল এলাকা থেকে ইসরায়েলি সেনাদের সরিয়ে নেওয়া হবে।
যুদ্ধবিরতির সময় হামাস ‘নির্দিষ্ট সংখ্যক’ জিম্মিকে মুক্তি দেবে। তাদের মধ্যে নারী, বয়স্ক ব্যক্তি এবং আহত জিম্মিরা থাকবেন। এর বিনিময়ে ইসরায়েলে বন্দি থাকা কয়েকশ মানুষকে মুক্তি দেওয়া হবে। এ ছাড়া হামাসের হাতে জিম্মি অবস্থায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মরদেহ পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দিতে হবে।
গাজার সব এলাকায় বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের তাদের বাড়িঘরে ফিরতে সুযোগ দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে গাজায় মানবিক সহায়তা কার্যক্রম বাড়ানো হবে। গাজায় প্রতিদিন মানবিক সহায়তাবাহী ৬০০ ট্রাক ঢুকতে দেওয়া হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গাজাবাসীর জন্য হাজারো সাময়িক আবাসনের ব্যবস্থা করবে।
ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি চলাকালে যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারের মধ্যস্থতায় শান্তি আলোচনা চলমান থাকবে। যদি আলোচনা সফল হয়, তাহলে পরবর্তী পর্যায়ের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করা হবে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে বাদবাকি জীবিত জিম্মিদের মুক্তি দেবে হামাস। তাদের মধ্যে জিম্মি পুরুষ সেনারাও থাকবেন। সেই সঙ্গে গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর সর্বশেষ সেনাকেও সরিয়ে নেওয়া হবে। যুদ্ধবিরতিকে ‘স্থায়ীভাবে শত্রুতা বন্ধে’ উন্নীত করা হবে।
তৃতীয় পর্যায়ে জিম্মি ফেরানোর প্রক্রিয়া পুরোপুরি শেষ করা হবে। গাজার জন্য বড় ধরনের একটি ‘পুনর্গঠন পরিকল্পনা’ বাস্তবায়ন শুরু করা হবে। এর আওতায় মার্কিন ও আন্তর্জাতিক সহায়তায় গাজা উপত্যকায় বাড়ি, বিদ্যালয় ও হাসপাতাল পুনর্নির্মাণ করা হবে।
নিজ বক্তব্যে বাইডেন বলেন, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এবং রাজনীতিবিদদের একাংশ যে এখনই গাজা যুদ্ধের অবসান চায় না—সে সম্পর্কে তিনি ভালোভাবেই ওয়াকিবহাল। তিনি আরও বলেন, এই মহলটির নির্দেশনা অনুযায়ী চললে সামনে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।
‘তারা গাজা দখল করতে চায়। এ কারণেই তারা সেখানে বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে আগ্রহী এবং জিম্মিদের মুক্তির ব্যাপারেও তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি জানি, যে পরিকল্পনা আমি প্রস্তাব করছি, তাতে ইসরায়েলি নেতৃত্বের একটি অংশ ব্যাপকভাবে আপত্তি জানাবে; কিন্তু তারপরও আমি ইসরায়েলের নেতৃত্বকে এই পরিকল্পনা সমর্থনের উদাত্ত আহ্বান জানাব।’
বাইডেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ও একমাত্র প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি যুদ্ধের সময়ে ইসরায়েল সফরে গিয়েছি। শুধু তাই নয়, এই যুদ্ধের সুযোগে ইরান যখন লোহিত ও পারস্য সাগরে জাহাজগুলোর ওপর হামলা চালানো শুরু করল, তখন আমি সেখানে মার্কিন বাহিনী পাঠিয়েছি। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্ট এর আগে এমন পদক্ষেপ নেননি।
‘তাই ইসরায়েলে ক্ষমতাসীনদের প্রতি আমার আহ্বান, এখন বিরতি দিন এবং একবার চিন্তুা করুন—এখন একটি বিশেষ সময়ে আমরা রয়েছি সবাই। যদি অবহেলায় এই সময় পেরিয়ে যায়, তাহলে কী ভয়াবহ ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।’
মার্কিন রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, গাজা যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সামনে এক অভূতপূর্ব দোদুল্যমান অবস্থার সৃষ্টি করেছে। একদিকে দীর্ঘদিন ধরে তিনি ইসরায়েলের দৃঢ় সমর্থক যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলপন্থি কমিউনিটির কাছে বেশ জনপ্রিয়, অন্যদিকে তার রাজনৈতিক দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির একটি বড় অংশে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ এবং সেখানকার ফিলিস্তিনিদের বিপর্যয়কর পরিস্থিতির জন্য তাকে দায়ী করছেন। গাজা ইস্যুতে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মধ্যে যে দিন দিন তার প্রতি ক্ষোভ বাড়ছে, তার আঁচ ভালোভাবেই পাচ্ছেন বাইডেন।
এদিকে, আগামী নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে যুক্তরাষ্ট্রে। সেই নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী হচ্ছেন জো বাইডেন; আর গত নির্বাচনের মতো এবারও তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী এবং বাইডেনের পূর্বসূরী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মার্কিন রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, গাজা ইস্যুতে এই মুহূর্তে যদি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়, তাহলে নির্বাচনে তার সুফল ভোগ করবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
তবে সবকিছুর পরও সত্য হচ্ছে, ইসরায়েলের একজন দৃঢ় সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও ফিলিস্তিনিদের প্রতি যথেষ্ট সহমর্মিতা বোধ করেন তিনি। শুক্রবারের ভাষণে তার ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে।
ভাষণে বাইডেন বলেছেন, এই যুদ্ধের উছিলায় গত প্রায় আট মাস ধরে ফিলিস্তিনের সাধারণ জনগণ নরকের চূড়ান্ত রূপ দেখছে। চলতি সপ্তাহে রাফায় যে ভয়াবহ হামলা ঘটল, সেই হামলার বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ফুটেজ রীতিমতো শিউরে ওঠার মতো। এখন সময় এসেছে এই যুদ্ধ থামানোর এবং এটি থামাতে হবে।
মন্তব্য করুন