একটি প্রকৃত আদর্শ রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ও প্রেক্ষাপটের স্বরূপ কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক ম্যাক্স ওয়েবার তার ‘মেথডলোজি অব সোশ্যাল সায়েন্স’ বইয়ে আলোকপাত করেছেন। ওয়েবারের মতে, একটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মোটাদাগে দুটি বিষয় প্রতিফলিত হয়; প্রথমত, একটি জাতিগোষ্ঠীর সামগ্রিক চাহিদা বা প্রত্যাশার বিবেচনা এবং দ্বিতীয়ত, একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা। ওয়েবার আরও একটি বিষয় দেখিয়েছেন যে, কোনো জাতিগোষ্ঠীর কাছে রাজনৈতিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে যেমন রাজনৈতিক দল তৈরি হয়, তেমনি ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে যুদ্ধ, মূল্যস্ফীতি, মন্দা কিংবা গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটেও রাজনৈতিক দল তৈরি হতে পারে। ওয়েবারের মতের সঙ্গে সামঞ্জস্য পরবর্তীকালে অন্যান্য তাত্ত্বিক যেমন গ্যাব্রিয়েল এলমন্ড আর সিডনি ভার্বার লেখাতেও পাওয়া যায়। সুতরাং, এক কথায় বলা চলে, একটি জাতির ভাগ্য বা ইতিহাসের বাঁকবদলের জন্য তৈরি হয়ে থাকে একটি রাজনৈতিক দল।
১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমরা এ দুই ধরনের প্রয়োজনের চিত্রই দেখতে পাই। একদিকে, জাতিগত দিক থেকে এক অন্তর্ভুক্তিমূলক বাঙালি জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের অধীনে, বাঙালির ভাষার প্রশ্নে, নিজ সংস্কৃতির প্রশ্নে গণআন্দোলনের জন্য সংঘবদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। অন্যদিকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জনসাধারণের কাছে ক্রমাগত বৈধতার প্রশ্নে সংকটের দিকে এগোচ্ছে। এমনি স্থান-কালের এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয়ের রাজনৈতিক পরিস্ফুটন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। যদিও শুরুতে এর নাম পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, পরে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ থেকে ১৯৫৫ সালে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ‘আওয়ামী লীগ’ নামধারণ করে। আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের রাজনীতিতে আসে মূলত বাঙালির রাজনৈতিক দাবি-দাওয়াকে সাংগঠনিক আদলে উপস্থাপন করার পাটাতন ও বাঙালির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরির অবকাঠামো হিসেবে। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রেজিমের অধীনে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা ধরে রেখেছে, প্রাথমিকভাবে বাঙালি জাতির ও পরবর্তীকালে সামগ্রিকভাবে দেশের প্রয়োজনের মুহূর্তগুলোতে এই দলই ছিল এ ভূখণ্ডের ত্রাণকর্তা। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে যাদের জন্ম গত শতাব্দীর শেষদিকে অথবা চলমান শতাব্দীতে, তাদের বড় একটি অংশ আওয়ামী লীগকে শুধু সরকারি দল হিসেবেই দেখেছে, বিরোধী দল হিসেবে দেখেনি। আওয়ামী লীগের গত ৭৫ বছরের পুরো ইতিহাস তারা কতটুকু জানে, সেটিও আমাদের জানার সুযোগ হয়নি। আওয়ামী লীগকে নির্মোহ মূল্যায়ন করার জন্য ‘সরকারি দল আওয়ামী লীগ’ এবং ‘রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ’-এর আলাদা আলাদা বিশ্লেষণ করলে সবচেয়ে ভালো মূল্যায়ন হয়। যদিও দুই ফরম্যাটেই আওয়ামী লীগ উপমহাদেশের সবচেয়ে সফল রাজনৈতিক সংগঠন, তবুও সরকারি দলে থাকলে সবার মন রক্ষা করে চলা সম্ভব হয় না। নানান মত ও পথের মানুষের নানান রকম প্রত্যাশা থাকে, সবার প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে একই বিষয়ে যখন একাধিক মতামত, একাধিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকে, তখন সরকারের যে কোনো একটিকে গ্রহণ করতে গিয়ে বাকিদের অনিবার্য সমালোচনার শিকার হতে হয়। ফলে সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে মূল্যায়নের আগে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের মূল্যায়ন অধিকতর যৌক্তিক।
রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের পৌনে একশ বছরের আন্দোলন সংগ্রামের ডায়েরিতে অনেক অর্জনের মধ্যে সবচেয়ে বড় অর্জন হলো ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’। তবে এ ক্ষেত্রে ‘দল’ আওয়ামী লীগের পাশাপাশি ক্যারিশমেটিক লিডার ‘ব্যক্তি’ বঙ্গবন্ধুর অবদানও অসীম। এটি আওয়ামী লীগের সৌভাগ্য যে, আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর মতো একজন বিশ্বমানের নেতা পেয়েছিল। বিশ্ব রাজনীতির সহস্র বছরের ইতিহাসে একটি রাজনৈতিক দলের একজন নেতার একক নেতৃত্বে মাত্র ২০-২২ বছরের কম সময়ের মধ্যে একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস নজিরবিহীন।
বাংলাদেশকে স্বাধীন করার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ছাড়াও ছোটখাটো আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কমবেশি সম্পৃক্ততা ছিল বটে, কিন্তু বাংলাদেশকে স্বাধীন করা যে একমাত্র আওয়ামী লীগেরই প্রধানতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল, এর অকাট্য প্রমাণ হচ্ছে আওয়ামী লীগ অন্য দশটি সংগঠনের মতো আত্মপ্রকাশের পর থেকে সেদিনটিকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হিসেবে গ্রহণ করে নেয়নি, বরং আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার আগেই আত্মপ্রকাশের দিন হিসেবে এমন একটি দিনকে বেছে নিয়েছিল, ঠিক এর দুইশ বছর আগে যে দিনে পলাশীর যুদ্ধে এ অঞ্চলের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। সেই ২৩ জুনকেই স্বাধীনতার নব-উদয়ের দিন হিসেবে বেছে নেয় আওয়ামী লীগ। সুতরাং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আওয়ামী লীগের ‘বাইচান্স আন্দোলন’-এর ফল নয়, বরং ‘বাইচয়েস আন্দোলন’-এর ফসল।
স্বাধীনতা অর্জন ছাড়াও গত ৭৫ বছরে বাংলাদেশের যত গুরুত্বপূর্ণ অর্জন, প্রায় সবই আওয়ামী লীগের হাত ধরে এসেছে। ১৯৪৭ সালে ‘ভুল পলিসি’ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান গঠিত হওয়ার পরই তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর প্রথম আঘাত হানে আর সেই আঘাতের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়েই জন্ম হয় আওয়ামী লীগের। এরপর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৪-তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন এবং ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ! এ সবকিছুই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে হয়েছে। কথায় আছে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন।
আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো, এখনো এই দেশ থেকে ৭১-এর পরাজিত শক্তিকে পুরোপুরি নির্মূল করতে পারেনি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটাক্ষ করা কীটপতঙ্গদের বিনাশ করতে পারেনি, উগ্র মৌলবাদের আস্ফালন থেকে দেশের রাজনীতিকে মুক্ত করতে পারেনি, বঙ্গবন্ধুর অবশিষ্ট পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে পারেনি, সার্বজনীন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বজনীন করে তোলার জন্য কোনো উদ্যোগ নেয়নি! তবে আমরা মনে করি, আওয়ামী লীগ বসে থাকার দল নয়। উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ভারতে যা করতে পারেনি, আওয়ামী লীগ তা বাংলাদেশে করেছে। আরেক প্রাচীন রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ পাকিস্তানে যতটা অজনপ্রিয় হয়েছে, বিপরীতে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে ততটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আওয়ামী লীগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র আছে। আওয়ামী লীগ সরকারি দলের চেয়ে বিরোধী দলে বেশি শক্তিশালী থাকে, আওয়ামী লীগ সংকটে ঐক্যবদ্ধ থাকে, আওয়ামী লীগ স্বৈরশাসন কিংবা যে কোনো রূপের অগণতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলতে থাকে, আওয়ামী লীগ কখনো অন্য কোন দলকে ভাঙার চেষ্টা করে না, দেশবিরোধী কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্বকে আওয়ামী লীগ অরাজনৈতিকভাবে নির্মূলের চেষ্টা করে না, আওয়ামী লীগ কখনো কারও গলায় পা দেয় না, তবে গুলপট্টি স্বভাবের কেউ হলে তার জন্য অগ্নিবাণ হতেও কালক্ষেপণ করে না।
মানুষ যাকে ভালোবাসে, যার কাছে ভালো কিছুর প্রত্যাশা থাকে তারই বেশি সমালোচনা করে। এ দেশের তরুণ প্রজন্ম সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করে আওয়ামী লীগের, কারণ আওয়ামী লীগের কাছে তাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি।
আওয়ামী লীগের সবচেয়ে ভালো বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা তারুণ্যের সমালোচনাকে স্বাগত জানায়, যৌবনের উদ্যমী স্রোতকে সমীহ করে, নবীনের সৃজনশীলতাকে ধারণ করে, তারুণ্যের চিন্তায় নিজেদের বিম্বিত করে। ফলে হাজারো সমালোচনার পরও এ দেশের তরুণ প্রজন্ম আওয়ামী লীগকেই তাদের আশা-ভরসার শেষ আশ্রয় মনে করে। স্বাধীনতা সংগ্রামের রক্তক্ষয়ী ইতিহাস এ দেশের তরুণ প্রজন্মের মানসপটে যে চিত্র এঁকে দিয়েছে, সেই চিত্র তাদের চিন্তায়, চেতনায়, মননে ও কর্মে প্রতিফলিত হয়। ৭৫ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ তাই এ দেশের তারুণ্যের চৈতন্যে মুক্তি ও স্বাধীনতার এক প্রোজ্জ্বল ক্যানভাস। তারা জানে বাংলাদেশের শিকড়ের নাম আওয়ামী লীগ। শিকড় আক্রান্ত হলে গাছ যেভাবে অক্সিজেন শূন্যতায় ভোগে, আওয়ামী লীগ আক্রান্ত হলে এ দেশের জনগণ সুশাসন ও গণতন্ত্রহীনতায় ভোগে। তারা বিশ্বাস করে, বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে আওয়ামী লীগকে যত্ন করে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণের দৃপ্ত শপথে ৭৫ বছর বয়সী আওয়ামী লীগের রক্তে ১৮ বছর বয়সী সংগ্রামী তারুণ্যের জয়ধ্বনি হোক, এটাই প্রত্যাশা। গতকাল ছিল ঐতিহ্যবাহী এ দলটির ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। অপরাজেয় বাংলার অজেয় তারুণ্যের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের জন্মদিনে আবির-রাঙা শুভেচ্ছা।
লেখক: কারিগরি শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ, সাবেক সভাপতি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি