আতাউর রহমান, ব্রাহ্মণপাড়া (কুমিল্লা) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১১:০২ এএম
অনলাইন সংস্করণ

সিজার উপেক্ষা করে নরমাল ডেলিভারিতে ঝুঁকছে ব্রাহ্মণপাড়ার নারীরা

ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডেলিভারি রুম। ছবি : কালবেলা
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডেলিভারি রুম। ছবি : কালবেলা

সারাদেশে যখন বাচ্চা প্রসব করাতে চলছে অস্ত্রোপচারের (সিজার) প্রতিযোগিতা ঠিক এই সময়টিতে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অস্ত্রোপচার ছাড়াই স্বাভাবিক প্রসবের (নরমাল ডেলিভারি) মাধ্যমে সন্তান জন্মের হার দিন দিন বাড়ছে।

‘স্বাভাবিক সন্তান প্রসবকে হ্যাঁ, সিজারকে না বলুন’ এই স্লোগানকে লালন করে উপজেলার প্রসূতি মায়েদের স্বাভাবিক প্রসবের মাধ্যমে সন্তান জন্মের বিষয়ে নানা পরামর্শ ও সহযোগিতা করে আসছে এই প্রতিষ্ঠানটি। যে কারণে স্থানীয়দের প্রশংসা কুড়াচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটি।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবু হাসনাত মো. মহিউদ্দিন মুবিনের নেতৃত্বে দলবদ্ধভাবে এ কাজটি পরিচালনা করছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কয়েকজন চিকিৎসক, নার্স ও মিডওয়াইফরা।

জানা গেছে, জেলার সবচে ছোট উপজেলা ব্রাহ্মণপাড়া। অস্ত্রোপচারের কুফল থেকে প্রসূতি মায়েদের ও নবজাতকদের সুরক্ষা দিতে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘স্বাভাবিক সন্তান প্রসবকে হ্যাঁ, সিজারকে না বলুন’ এই স্লোগান। এরই সুফল হিসেবে গত কয়েক বছরে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসবের হার। আর এই বিশেষ উদ্যোগকে বাস্তবে রূপ দিতে নিরলস পরিশ্রম করে শুদ্ধাচার পুরস্কার ২০২২ পেয়েছেন জান্নাতুল ফেরদৌস নামের প্রতিষ্ঠানটির এক মিডওয়াইফ।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, এ উপজেলায় দিন দিনই বাড়ছে স্বাভাবিকভাবে সন্তান জন্মের হার। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গত এক বছরে প্রসব পূর্ববর্তী এএনসি সেবা নিয়েছেন ২ হাজার ৯৮৮ জন প্রসূতি মা। এ ছাড়াও প্রসব পরবর্তী পিএনসি সেবা নিয়েছেন ৫০১ জন মা। তবে দিন দিনই এ সেবার প্রতি ঝুঁকছেন প্রসূতি মায়েরা।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেসরকারি হাসপাতাল আর ক্লিনিকের কারণে স্বাভাবিক প্রসব প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এই সেবার মানোন্নয়নের ফলে দিন দিনই বাড়ছে স্বাভাবিক প্রসবের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেওয়ার হার। অন্যদিকে গ্রামের অদক্ষ দাইদের হাতে প্রসব করিয়ে নানা জটিলতা থেকেও মুক্তি পেয়েছে প্রসূতিরা। তবে কিছু দালালচক্র সক্রিয় রয়েছে, তারা নানা কৌশলে প্রসূতি ও তার স্বজনদের ভুলভাল বুঝিয়ে এখনো প্রাইভেট হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এই সেবার মান অক্ষুণ্ণ থাকলে এ উপজেলায় প্রায় শতভাগ স্বাভাবিক প্রসবের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করবে বলে আশা করছেন স্থানীয়রা।

প্রসূতি সালমা আক্তার কালবেলাকে জানান, মধ্যরাতে প্রসব ব্যথা ওঠে তার। পরে রাতেই স্বজনদের নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন তিনি। আসার পরপরই চিকিৎসক ও মিডওয়াইফরা তাকে ডেলিভারি ওয়ার্ডে নিয়ে যান। সেখানে কিছুসময় চেষ্টার পর স্বাভাবিক প্রসবের মাধ্যমে তিনি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন।

আরেক প্রসূতি পারভীন আক্তার কালবেলাকে বলেন, মানুষজন থেকে শুনে আসছি সরকারি হাসপাতালে ভালো সেবা পাওয়া যায় না। তবে নিজে এসে সেবা নিয়ে আমাদের সে ভুল ভেঙেছে। প্রসব ব্যথা নিয়ে গতকাল হাসপাতালে আসি, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই চিকিৎসক ও তার সহযোগীদের প্রচেষ্টায় প্রথমবারের মতো আমি মা হয়েছি।

রৌশন জাহান কালবেলাকে জানান, প্রসব ব্যথা উঠলে তিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া সেবায় সিজারিয়ান অপারেশন ছাড়াই নরমাল ডেলিভারিতে সন্তান প্রসব করেন। এজন্য তাকে কোনো খরচ গুণতে হয়নি। তিনি এবং তার সন্তান সুস্থ আছেন।

অপর এক প্রসূতি সামিয়া ইসলাম কালবেলাকে বলেন, সরকারি হাসপাতালে এতো দ্রুত সেবা পাওয়া যায় না আসলে বিশ্বাস করতাম না। হাসপাতালে আসার দেড় ঘণ্টার মাথায় চিকিৎসক ও উনার সহযোগীদের চেষ্টায় নরমাল ডেলিভারি সেবা পেয়েছি।

স্থানীয় বাসিন্দা আমিরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, একটা সময় শিশু জন্মের অধিকাংশই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হতো। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসবের সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছার কারণে স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসবের দিকে ঝুঁকছে উপজেলাবাসী।

সিজারের কুফল সম্পর্কে জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক শঙ্খজিৎ সমাজপতি কালবেলাকে বলেন, সন্তান জন্মদান সত্যিই গর্বের ও আনন্দের। দীর্ঘ ১০ মাস গর্ভধারণ শেষে সন্তানের মুখ দেখার খুশির চেয়ে একজন মায়ের পৃথিবীতে এরচেয়ে বড় খুশি আর কিছুতে নেই। তবে এটা যদি হয় স্বাভাবিক প্রসবের পরিবর্তে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাহলে ওই মায়ের জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ডেলিভারিতে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যার ফলে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেওয়া মা বিভিন্ন সমস্যায় ভোগেন। ওইসব মায়েদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কোমড় ব্যথা নিয়ে বাঁচতে হয়। এ ছাড়াও আরও নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।

তিনি বলেন, অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুটিও জন্মগতভাবে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম নিয়ে জন্মায়। এসব বাচ্চাগুলোর শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকার কারণে এরা সহজেই যেকোনো রোগে আক্রান্ত হয়। যার ফলে সিজারিয়ান বাচ্চাগুলো খুব ঘন ঘন অসুস্থ হয়। স্বাভাবিক প্রসবের মাধ্যমে জন্মানো বাচ্চাদের তুলনায় সিজারিয়ান বাচ্চাদের মেধা কম থাকে। যে হারে দিন দিন অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্মের হার বাড়ছে তাতে একটি জাতি দিন দিন নীরবে পিছিয়ে পড়ছে। তবে আমাদের ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তার জোরালো ভূমিকায় এ উপজেলায় দিন দিন স্বাভাবিকভাবে সন্তান জন্মের দিকে ঝুঁকছেন প্রসূতি মায়েরা। দিন দিনই বাড়ছে এর সংখ্যা।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবু হাসনাত মো. মহিউদ্দিন মুবিন কালবেলাকে বলেন, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের বদৌলতে পাওয়া সিজার মানুষের কল্যাণেই ব্যবহার হওয়ার কথা। যখন স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব করা যাচ্ছে না, এদিকে প্রসূতি মায়ের অবস্থাও সংকটাপন্ন, এমতাবস্থায় সিজার করার প্রয়োজন আছে। তবে বর্তমানে সিজার একটি ট্রেডিশনে রূপ নিয়েছে। এই সিজারের ফলে সিজারিয়ান বেবি ও মা দুজনই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

তিনি বলেন, উপজেলার প্রায় প্রতিটি প্রসূতি মায়েদের ডাটাবেজের মাধ্যমে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। প্রসব পূর্ববর্তী ও পরবর্তী পরামর্শ ও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এ কারণেই এ উপজেলায় দিন দিন নরমাল ডেলিভারির সংখ্যা বাড়ছে।

ডা. আবু হাসনাত মো. মহিউদ্দিন মুবিন আরও বলেন, প্রসবকালীন মাতৃ মৃত্যুর হার কমাতে এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নরমাল ডেলিভারিকে উপজেলাবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে আমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা জরুরি সেবা প্রদান করা হচ্ছে। চিকিৎসকসহ একদল দক্ষ মিডওয়াইফরা সর্বদা এই বিষয়ে তৎপর রয়েছে। এই সেবা নিতে বেসরকারি হাসপাতালে সিজারের মতো টাকা গুনতে হয় না। সরকার বিনামূল্যে এই সেবা প্রদান করছে। সকলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা পেলে আমি বিশ্বাস করি এই উপজেলায় সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেওয়া শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

চার বছরেই লাভজনক অবস্থানে যেতে চায় ন্যাশনাল ব্যাংক

কুমিল্লা বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১২ হাজার

মাদ্রাসা বোর্ডে পাসের হার ৭৯.৬৬ শতাংশ, জিপিএ-৫ কত?

মাদ্রাসায় না আসায় শিশুশিক্ষার্থীকে বেধড়ক মারল শিক্ষক

এ বছর পাসের হার কত বাড়ল?

এক শর্তে কালই গাজায় যুদ্ধবিরতি সম্ভব : বাইডেন

জিএসটির ‘সি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ

চিত্রা নদীতে গোসলে নেমে কিশোর নিখোঁজ

গাড়িচাপায় নিহত মাকে জড়িয়ে কাঁদছে শিশু

মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা কেন পিছিয়ে, কারণ খুঁজতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ

১০

মরুর বুকে চড়বে উঠ, বসানো হলো ট্রাফিক সিগন্যাল

১১

এসএসসিতে পাসের হার ৮৩ দশমিক ০৪ শতাংশ

১২

কোন বোর্ডে পাসের হার কত?

১৩

মাহমুদউল্লাহর ব্যাটে টাইগারদের মানরক্ষা

১৪

পাসের হারে শীর্ষে যশোর, কম সিলেটে

১৫

ফেনীতে কোটি টাকার রাস্তা নির্মাণ নিয়ে নয়ছয়ের অভিযোগ

১৬

এসএসসি-সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ

১৭

মধুমাস জ্যৈষ্ঠর আগেই আমে সয়লাব সাতক্ষীরার বাজার, দাম দ্বিগুণ

১৮

হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি

১৯

পাবিপ্রবিতে নেই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, হয় না সঠিক কাউন্সিলিং

২০
X