'বুয়েটে শিবির ও হিযবুত বলে কিছু নেই', 'বুয়েটের শিবির-হিযবুত সব গুজব', 'ছাত্র রাজনীতি ফেরাতে সরকার গুজব করছে', 'আসলে বুয়েটের সামনের বাজেটে ভাগ চায় বলে হিযবুত-শিবির নিয়ে নাটক করছে ছাত্রলীগ'- এমন অসংখ্য গুজব ঘুরে বেড়াচ্ছে বুয়েট কেন্দ্রীক বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ, পেজ ও কিছু সাবেক বুয়েটিয়ানদের প্রফাইলে।
বুয়েটে হিযবুত-শিবিরের কার্যক্রম নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় গণমাধ্যমকেও আক্রমণ করছেন তারা। এখন বুয়েটে হিযবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণের ফুটেজ গণমাধ্যমে প্রকাশ্যে আসার পর তারা প্রশ্ন তুলেছেন, এই ফুটেজ গণমাধ্যমের কাছে গেল কীভাবে? মূল ঘটনায় না থেকে তারা ঘটনা ভিন্নদিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছেন। তবে কী বুয়েটে জঙ্গিবাদকে অস্বীকার করার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অবাধে হিযবুত তাহরীর ও শিবিরের কার্যক্রম চালাতে তৎপর হয়ে উঠেছে একটি গোষ্ঠী?
সোমবার রাতে হঠাৎ করেই ফেসবুকে আটকে যায় আমার চোখ। অনেকগুলো গণমাধ্যমে একে একে প্রকাশ হতে থাকে প্রিয় বুয়েট ক্যাম্পাসকে ঘিরে হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রমের জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। দেখা যায়, বুয়েটের সিভিল বিল্ডিংয়ে দুই তরুণ হিযবুত সদস্য কীভাবে লুকোচুরি খেলে ক্লাসরুম গুলোতে পৌঁছে দিচ্ছে লিফলেট। সেই সঙ্গে আরও একবার আতকে উঠি এটা ভেবে যে, বুয়েটের নিরাপত্তা কোথায়? যদি লিফলেটের বদলে অন্য কিছু থাকত, যা শিক্ষার্থীদের জীবন বিপন্ন করত? তখন বুয়েট কর্তৃপক্ষ কাদের কাছে জবাবদিহীতা করতো এবং কাকে শাস্তি আওতায় আনত? নাকি তখনও বুয়েটে জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় সাংবাদিকদেরকেই উল্টো নিন্দা জানাতেন?
যে কোনো সমস্যার টেকসই সমাধান করতে আগে সমস্যাটিকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করতে হয়। তারপর তা সমাধানে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু বুয়েট কর্তৃপক্ষ ও কিছু শিক্ষার্থীদের কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়টিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদী গোষ্ঠির কার্যক্রমকে অস্বীকার করতে পারলেই তারা রক্ষা পায়। কিন্তু এভাবে অস্বীকার করার মাশুল বাংলাদেশকে এক সময় দিতে হয়েছে। সেই ইতিহাস থেকে বুয়েট কর্তৃপক্ষ ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।
বাংলাদেশের এক সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলা ভাই ও জেএমবির কার্যক্রম অস্বীকার করে বলেছিলেন, ‘দেয়ার ইজ নো বাংলা ভাই। সব মিডিয়ার সৃষ্টি।’ চোখ বন্ধ করে রাখা এই বুয়েটিয়ানরাও বলছেন ‘কোথায় হিযবুত তাহরীর, কোথায় শিবির? সব মিডিয়ার সৃষ্টি।‘
ছাত্র রাজনীতির গুজব ছড়িয়ে গত মাসের শেষের দিকে বুয়েটে শুরু হয় অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বর্জন। গত ২৮ মার্চ মধ্যরাতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি বুয়েটে প্রবেশ করে ছাত্রলীগের কমিটি দিচ্ছে এমন গুজব ছড়িয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়। এ সময় ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে এক শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার ও তার সঙ্গে থাকা অন্যান্য শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করে বহিষ্কারের দাবি জানানো হয়। সেইসঙ্গে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ বহালের দাবিও জানানো হয়। শেষমেশ বিষয়টি গড়ায় হাইকোর্ট পর্যন্ত। যেখানে উচ্চ আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয়, বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চলতে বাধা নেই।
এমন পরিস্থিতিতে ঈদের ছুটির আগেই বুয়েট প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপাচার্য ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার আদালতের রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর আইনি লড়াইয়ে যাবার ঘোষণা দেন। এরপরেও ঈদের পর বুয়েট ক্যাম্পাস খোলার পর কিছু শিক্ষার্থী পরীক্ষা বর্জনের জন্য কথা বলতে শুরু করে। কিন্তু যেই বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে আদালতে ও আইনি প্রক্রিয়ায়, সেখানে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বন্ধের যৌক্তিকতা কী? আইনি লড়াই চলমান অবস্থায় পরীক্ষা বর্জনের জন্য কেনো কিছু শিক্ষার্থী বারবার উস্কানি প্রদান করছেন? কারা এই মেধাবী শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে তাদের সেশনজটের ফাঁদে ফেলছে?
২০১৯ সালে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও সেখানে কার্যক্রম চালিয়ে গেছে জামায়াতে ইসলামের ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির ও হিজবুত তাহরীর। এরইমধ্যে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে চলমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীদের ইমেইল দিয়েছে নিষিদ্ধ উগ্রবাদী সংগঠন হিজবুত তাহরীর। শিক্ষার্থীদের ইমেইলে একাধিকবার উগ্রবাদী বার্তা ও রাজনীতি বন্ধের বার্তা দিয়ে মেইল করার পর নিজেদের ফেসবুক পেজের একটি ভিডিওর কিউআর কোড স্টিকার আকারে ছাপিয়ে পলাশীর মোড় থেকে শুরু করে বুয়েটের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিচ্ছে উগ্রবাদী গোষ্ঠীটি। শুধু তাই নয় বুয়েটে হিজবুতের লিফলেট বিতরণের ভিডিও সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে। বুয়েটে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে আন্দোলনের শুরুর দিকে বুয়েটে জামায়াতে ইসলামির ছাত্র সংগঠন শিবির ও নিষিদ্ধ সংগঠন হিজবুত তাহরীরের কার্যক্রম নিয়ে কোনো আপত্তির কথা জানানো হয়নি। কিন্তু গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে তারা এই বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে বাধ্য হয়।
তবে আন্দোলনকারীদের একটি অংশের পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই দুই সংগঠনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তেমন কোনো লেখা বা দাবি চোখে পড়েনি। বুয়েট কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও বলেনি। এখন তাদের কার্যক্রম দেখলে মনে হবে ‘ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলেই বুয়েট ঠিক হয়ে যাবে। জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ কোনো সমস্যাই নয়।‘
কিন্তু এই জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের খপ্পরে পড়েই নিহত হয়েছিল বুয়েটের ০৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী রেশাদ। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবের রাতে নিহত ১১ হেফাজত কর্মীর একজন সে। এই জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের কারণেই নিহত হতে হয়েছিল আরিফ রায়হান দীপকে। এই জঙ্গি মৌলবাদী শক্তির নির্দেশেই আরিফ রায়হান দীপকে হত্যা করেছে বুয়েটের অপর শিক্ষার্থী হেফাজতে ইসলাম সমর্থক মেজবাহ। এই মৌলবাদী গোষ্ঠীর আক্রমণের শিকার হয়ে বুয়েটের প্রাক্তন ছাত্রনেতা ও গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক তন্ময় আহমেদ মূমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এখনো ১৩০টি সেলাই নিয়ে বেঁচে আছেন এই বুয়েট শিক্ষার্থী। এর আগে ২০০২ সালে ছাত্রদের সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন আরেক মেধাবী বুয়েটিয়ান সাবেকুন নাহার সনি। এক আবরার ফাহাদ হত্যার জন্য বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হলে এতগুলো হত্যার জন্য যে মৌলবাদী গোষ্ঠী দায়ী তার বিরুদ্ধে আওয়াজ কেন উঠছে না? নাকি পরিকল্পিতভাবে শিক্ষার্থীদের ভুল পথে পরিচালিত করছে একটি গোষ্ঠী? এভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ব্যস্ত রেখে নিজেদের মৌলবাদী কার্যক্রমকে গতিশীল করতে চাইছেন কারা?
বুয়েটকে কেন্দ্র করে আরও একবার গুজব প্রচারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে একটি গোষ্ঠী। মানবাধিকারের নামে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কলঙ্কিত করছে। সোচ্চার নামক ফেসবুক পেজ থেকে এবং ওয়েবসাইট থেকে সরাসরি একজনের বক্তব্য প্রচার করা হচ্ছে যিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে ‘প্রহাসনের বিচার’ বলে মন্তব্য করেছেন এবং সেটি প্রচার করছে স্বয়ং ‘সোচ্চার’।
শুধু তাই নয়, মৌলবাদী গোষ্ঠী জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন শিবিরের কার্যক্রমের প্রমাণকে অস্বীকার করার পাশাপাশি বুয়েটে শিবির সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের নিয়ে পরিচালিত হয়েছে ‘বুয়েট সাংবাদিক সমিতি’ নামের কো-কারিকুলার ক্লাব! এই সাংবাদিক সমিতির মাধ্যমেই বুয়েটের হলরুম ব্যবহার করে ছাত্রলীগ কমিটি দিচ্ছে বলে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বুয়েট সাংবাদিক সমিতির শীর্ষ পদের ৬ শিক্ষার্থীসহ বুয়েটের বর্তমান ২৪ জন এবং বুয়েটের সাবেক ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও ১০ জন শিক্ষার্থী রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্রের অপরাধে টাঙ্গুয়ার হাওরে আটক হন। এ সময় তারা কেনো আটক হয়েছে, সেটি নিয়েও আওয়াজ তোলার চেষ্টা করে বুয়েটের কিছু বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী। কিন্তু সুনামগঞ্জের জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ যখন গ্রেপ্তারকৃতদের শিবির কর্মী বলে নিশ্চিত করেন, তখন সাধারণ শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সংশ্লিষ্টতার জন্য এদের শাস্তির দাবি জানান। কিন্তু শিবির সংশ্লিষ্ট হবার পরও গ্রেপ্তারকৃত ছাত্রদের বহিষ্কার বা হল থেকে বের করে দেওয়া নিয়ে কেনো কথা বলে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং ‘ছাত্রলীগ’ ট্যাগ দিয়ে অন্য শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারের দাবি জানানোরা?
আর ‘ছাত্রলীগ করে’ বললেই হল থেকে বহিষ্কার করা যাবে, কিন্তু শিবির সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ থাকলেও বিষয়টি আদালতে প্রমাণ হয়ে আসতে হবে তারপর সবাই ব্যবস্থা নেবে, এমন দ্বিচারিতা কেন? শিবির ও মৌলবাদী শক্তির কারণে বুয়েটে হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি হবার পরও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এতো কুণ্ঠাবোধ কেন?
ছাত্র রাজনীতি করলেই কেউ রসাতলে যাবে, এমন ভাবার কারণ নেই। এখনও যারা বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা ছাত্র রাজনীতি করেই উঠে এসেছেন। যারা ছাত্র জীবনে রাজনীতি করেন, তারা পরে অন্য পেশায়ও নেতৃত্বের পর্যায়ে থাকেন। বুয়েটের যেই র্যাংকিং নিয়ে শিক্ষার্থীদের এত গর্ব, সেই র্যাংকিং অর্জনে যেই প্রশাসন ও শিক্ষকরা নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন, তারা প্রত্যেকেই ছাত্র রাজনীতি চলমান থাকা অবস্থায় বুয়েটের শিক্ষার্থী ছিলেন। এমনকি কেউ কেউ সরাসরি রাজনীতিতে যুক্তও ছিলেন। বিগত ৫ বছর শুধু বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ ছিল। তার আগেও বুয়েট সেরা মেধাবীদের স্থান ছিল। এটা অস্বীকার করবার কোনো উপায় আছে কি? তখন বুয়েটের যা অর্জন তা কী কিছুই নয়?
বুয়েটে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে ইফতার করালে হুমকি ও র্যাগিংয়ের মুখে পড়তে হয়। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধে ম্যুরাল থাকে অবহেলায়। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে বুয়েট কি এখন জঙ্গিবাদ আর সাম্প্রদায়িকতার নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র হয়ে উঠেছে? টাঙ্গুয়ার হাওরে গিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া শিবিরের নেতাকর্মীদের ব্যাপারে বুয়েটের একটি গোষ্ঠী নিজেরা নিশ্চুপ থাকছে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বিষয়টিকে ‘গুজব’ হিসেবে প্রমাণের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।
আর এ কারণেই বুয়েটের বর্তমান শিক্ষার্থীদের জন্য অনেকগুলো প্রশ্ন রেখে গেলাম। নিজেকে নিজে এই প্রশ্নগুলো করে সঠিক উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে হবে। চোখ-কান খোলা রেখে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। না হলে নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এমন এক বুয়েটকে রেখে যাওয়া হবে, যেখানে বুয়েট হয়ে উঠবে মৌলবাদের আঁতুড়ঘর। তখন কি কিছু করার থাকবে সাবেক বুয়েটিয়ানদের?
লেখক প্রকৌশলী কাজী খায়রুল বাশার বুয়েট '৮৯ ব্যাচ
মন্তব্য করুন