কৌশিক বসু
প্রকাশ : ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০২:১৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
কৌশিক বসুর নিবন্ধ

যেভাবে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছে যুক্তরাষ্ট্র

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সম্পর্কের অবনতির কারণে বিশ্বব্যাপী স্বৈরাচারী নেতৃত্ব এবং চরমপন্থি আন্দোলন গতিলাভ করেছে। বিশ্বের বেশিরভাগ অংশে গণতন্ত্র পশ্চাদপসরণ করেছে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা যখন চাপের মধ্যে পড়ে, তখন আমাদের লালিত আদর্শ, যেমন সকলের জন্য সমান স্বাধীনতা এবং অধিকার নিশ্চিত করার মতো বিষয় ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।

গণতান্ত্রিক চর্চা পিছিয়ে পড়ার অনেক কারণ রয়েছে, যার মধ্যে বড় বড় প্রযুক্তির আবির্ভাব এবং ভুল তথ্য ও বিভ্রান্তিকর খবরের দ্রুত বিস্তার অন্যতম। তবে যেটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে তা হলো অনিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন এবং রাজনৈতিক বলকানায়নের অদ্ভুত সম্মিলন। এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় শক্তিগুলো বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষের জীবনের ওপর অসম প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ওই সব মানুষের কোনো রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর নেই বিশেষত তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্ধারণে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেন না। অথচ তাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব।

গণতন্ত্রের মূল নীতি হলো, রাজনৈতিক নেতাদের সিদ্ধান্তের দ্বারা প্রভাবিত ব্যক্তিদের সেই নেতাদের নির্বাচন করার ক্ষেত্রে প্রভাব থাকতে হবে। এই ধারণাটি এতটাই মৌলিক যে এমনকি রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়ার মতো কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোও নির্বাচন করে, দৃশ্যত নাগরিকদের তাদের নেতা ‘বাছাই’ করার সুযোগ দেয়।

অবশ্য, এই নির্বাচনগুলো বিদ্যমান শাসনব্যবস্থার জন্য সত্যিকারের কোনো হুমকি হয়ে ওঠে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, উত্তর কোরিয়ার ২০২৩ সালের নির্বাচনে কিম জং-উনের ওয়ার্কার্স পার্টি ৯৯ দশমিক ৯১ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। এখান থেকেই প্রতীয়মান হয় কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোর নির্বাচনগুলো প্রহসন মাত্র।

সমস্যাটি বোঝার জন্য, একটি দৃশ্য কল্পনা করা যেতে পারে যে মার্কিন প্রেসিডেন্টরা শুধু কলম্বিয়া প্রদেশের ভোটারদের দ্বারা নির্বাচিত হবেন। ওয়াশিংটনের প্রতিটি বাসিন্দাদের ভোট দেওয়ার অধিকার থাকবে এবং সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া প্রার্থী রাষ্ট্রপতি হবেন। বাকি প্রদেশের ভোট প্রদানের অধিকার বা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের অধিকার থাকবে না। এই প্রক্রিয়াটি যদি প্রতারণা থেকে মুক্ত এবং স্বচ্ছও হয়, তবে এমন পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষষ্ট্রে গণতন্ত্র রয়েছে বলে বিবেচনা করা কঠিন হবে। কারণ নির্বাচিত নেতারা স্বাভাবিকভাবেই অন্য সব জায়গার আমেরিকানদের চেয়ে ওয়াশিংটনের বাসিন্দাদের স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেবেন, কারণ বাকিদের অবস্থান তাদের পুনঃনির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনার ওপর সামান্যতম প্রভাব ফেলবে না।

যদিও এই দৃশ্যটি অনেক দূরের বলে মনে হতে পারে। তারপরও বিশ্বের লোকজন নিজেদেরকে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য প্রদেশের মতো একই অবস্থানে খুঁজে পাবে, যেখানে নেতা নির্বাচনে তাদের কোনো অধিকার নেই কিন্তু নির্বাচিত নেতা তাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ ও শাসন করছে।। গত চার দশকের ত্বরান্বিত অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন, ক্রমবর্ধমান আন্তঃসংযুক্ত সরবরাহ চেইন এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি পুঁজি ও পণ্যের অবাধ প্রবাহকে সহজতর করেছে। এর মানে এই যে বড় শক্তিগুলো এখন মাত্র কয়েকটি ক্লিকের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ব্যক্তি ও সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করতে সক্ষম।

কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। যদিও আমেরিকান নেতা নির্বাচনে তাদের কোনো ভূমিকাই নেই। সাপ্লাই চেইন ছিন্ন করে বা আর্থিক প্রবাহে হেরফের করে অসংখ্য অর্থনীতিকে ধসিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর নাগরিকদের মার্কিন নির্বাচনের ওপর কোনো প্রভাব নেই।

একইভাবে, ইউক্রেনীয় বা জর্জিয়ান নাগরিকরা রাশিয়াকে শাসন করবে তা নির্ধারণে কোনো প্রভাব রাখতে পারে না, যদিও রাশিয়াকে কে শাসন করবে তার ওপর তাদের ভাগ্য ও মঙ্গল অনেকটাই নির্ভর করে।

বৈশ্বিক গণতন্ত্রের এই অবক্ষয়ের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এর ভূরাজনৈতিক পরিণতি হবে ভয়াবহ। যদিও মার্কিন সরকার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে কার্যকরভাবে পরিচালনা করার জন্য যথেষ্ট প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বৈদেশিক নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে অশ্বারোহী পন্থা অবলম্বন করেছে।

মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংকট আমাদের জন্য একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। গত ছয় মাস ধরে হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নিঃশর্ত সমর্থন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে উপকৃত করেছে। মার্কিন সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স এবং এলিজাবেথ ওয়ারেন যেমন উল্লেখ করেছেন, সাধারণ ইসরায়েলিদের লক্ষ্য, যারা যুদ্ধের অবসান ঘটাতে এবং জিম্মিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে চান, নেতানিয়াহু এবং তার উগ্র ডানপন্থি রাজনৈতিক মিত্রদের থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন, যারা যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করতে চান। ক্ষমতা নিজেদের দখলে রাখতে সংঘর্ষ আরও প্রলম্বিত করতে ইচ্ছুক নেতানিয়াহু ও তার উগ্র ডানপন্থি মিত্ররা।

এতে গণতন্ত্র বিরোধী ও আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো শক্তিশালী হচ্ছে। যদি ইসরায়েলের নাগরিকরা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিতে পারত, তাহলে আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য নীতি সম্ভবত ভিন্ন হতো। এই ধরনের নীতি নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক এজেন্ডার পরিবর্তে ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনি উভয়ের স্বার্থের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হতো। তবে ট্রাম্প মার্কিন নির্বাচনে জিতলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। কিন্তু আমি আশা করি, মার্কিন নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি জিতবে। সেক্ষেত্রে আমরা একটি ভিন্ন মধ্যপ্রাচ্য নীতি দেখতে পাব।

এই জটিলতার কোনো সহজ সমাধান নেই। ইসরায়েলিরা মার্কিন নির্বাচনে ভোট দেবে না এবং ইউক্রেনীয়রা রাশিয়ার পরবর্তী নেতা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।। ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং বিশ্বায়নের প্রসার এবং এর ফলে বিশ্ব গণতন্ত্রের ক্ষয়, বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দুর্বলতাগুলো আমাদের সামনে তুলে ধরে।

আমি যেমন আমার বই দ্য রিপাবলিক অব বিলিফসে বলেছি, রাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়াই বাধ্যতামূলক আইন ও প্রবিধান বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এরিক পসনার এবং ক্যাস সানস্টেইন সঠিকভাবে বলেছেন, মূল বিষয় হলো যথাযথ নিয়ম প্রণয়ন করা গেলে ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে সেটি বাস্তবায়ন করে। বর্তমান পরিস্থিতি এই বার্তাই দেয় যে, বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার লক্ষে আমাদের আরও কার্যকর বহুপাক্ষিক সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সনদ তৈরি করতে সচেষ্ট হতে হবে।

কৌশিক বসু: বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং ভারত সরকারের সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের একজন অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো।

কপিরাইট: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ২০২৪

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শিক্ষার্থীদের ট্যুরের টাকা গায়েবের অভিযোগ সদস্য সচিবের বিরুদ্ধে

মিনিস্টারে চাকরির সুযোগ, পদসংখ্যা ১০

৬ জুন বাজেট ঘোষণা

ইসরায়েল সংশ্লিষ্ট তিন জাহাজে ইয়েমেনিদের হামলা

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্রলীগ দখল করে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করেছে : ছাত্রদল সভাপতি

২১ মে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিতে পারে ইউরোপের চার দেশ

কারাগারে হাজতির মৃত্যু

ডলারের দাম বাড়ায় অর্থনীতির ওপর চাপ পড়বে না : সালমান এফ রহমান 

৯০০০ টাকার খাম ৩ লাখে বিক্রি করলেন ছাত্রলীগ নেতা

ইরানে বিরল ‘মাছবৃষ্টি’, আকাশ থেকে পড়ছে জীবিত মাছ

১০

কোরবানির আগেই গরু চুরির হিড়িক

১১

১০ জনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেবে ওয়ালটন, বয়স ২০ হলেই আবেদন

১২

দুর্ধর্ষ রূপে আসছেন টেলর

১৩

নয়াপল্টনে সমাবেশের অনুমতি পাচ্ছে বিএনপি, আছে শর্ত

১৪

বাংলাদেশে পালিয়ে এলো বিজিপির আরও পাঁচ সদস্য

১৫

রাতেই ৯ জেলায় ৮০ কিমি বেগে ঝড়ের আভাস

১৬

বিজ্ঞানী ওয়াজেদ মিয়া ছিলেন জাতির জন্য নিবেদিত : হাছান মাহমুদ

১৭

শুক্রবার টুঙ্গিপাড়া যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী

১৮

পরামাণু বোমা তৈরির হুঁশিয়ারি ইরানের

১৯

শনিবার ঢাকায় অঞ্জন দত্তের কনসার্ট

২০
X