মুসলিমদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর। ঈদ মানে খুশি, আনন্দ. ফুর্তি আমোদ ও উৎসব। ফিতর অর্থ ভঙ্গ করা, স্বভাবজাত বা স্বাভাবিক। মুসলমানদের জীবনে অপার আনন্দের বার্তা নিয়ে ঈদ আসে। ফিতর মানে ভঙ্গ করা।
পবিত্র রমজান মাসের সিয়াম আদায়ের পর শাওয়াল মাসের প্রথম দিন সকালে সিয়াম ভঙ্গ করে আল্লাহর বিশেষ নিয়ামতের শুকরিয়া স্বরূপ আনন্দ উৎসব করাই ঈদুল ফিতর। ইসলাম ধর্মে মুসলমানদের জন্য ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা নির্ধারিত হয়েছে।
রাসুল (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করলেন, সেখানে দেখতে পেলেন শিশু-কিশোর, আবাল-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ সবাই বছরে দুদিন আনন্দ-উৎসব করে থাকে। সাহাবিদের মধ্যেও আবেগ-আগ্রহ পরিলক্ষিত হওয়ায় আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সা.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা পালনের ঘোষণা দিলেন। (হুজ্জাতুল্লাহিল-বালিগা)
রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাবে, যেদিন সব আত্মা-অন্তর (কেয়ামতের দিন) মারা যাবে, সেদিন তার অন্তর মরবে না। অর্থাৎ কেয়ামত দিবসের কঠিন বিপজ্জনক অবস্থায় যখন সবাই ভীতসন্ত্রস্ত ও মৃতপ্রায় হয়ে পড়বে তখন এই ঈদের রাতে ইবাদতকারী বরং হাসিখুশির মধ্যে কাটাবে।’ (তাবারানি)
ঈদের রাতের ফজিলত বিষয়ে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেন, রমজান মাসের শেষ রজনিতে আল্লাহ তায়ালা তার বান্দার জন্য ক্ষমা ও দানের ফয়সালা করেন। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করেন, ওই রাতটিই কি শবে কদর? রাসুল (সা.) বলেন, না। কিন্তু নিয়ম হচ্ছে কর্মচারী যখন কাজ বুঝিয়ে দেয় তখন তার পাওনাও পরিশোধ করে দেওয়া হয়। (মুসনাদে আহমদ)
রাসুল (সা.) বোঝাতে চেয়েছেন, রোজাদারের আমল এদিন শেষ হয়। আর তখন আল্লাহ তায়ালার ঘোষণামাফিক যার যা প্রতিদান তা দেওয়া হয়। তাই ঈদের রাতে তওবা, ইস্তিগফার ও ইবাদতে মশগুল থাকা উত্তম। এ প্রসঙ্গে ‘আল মাওসূয়াতুল ফিকহিয়া আল কুয়েতিয়া’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘মুস্তাহাব হচ্ছে, উভয় ঈদের রাতে আল্লাহর ইবাদত, জিকির, তেলাওয়াত ও তাসবিহ-তাহলিলে মশগুল থাকা।’
ঈদের দিনের আনন্দ বিষয়ে হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা মিনায় অবস্থানের দিনে হজরত আবু বকর (রা) তার কাছে হাজির হলেন। তখন আয়েশার কাছে দুটি বালিকা বসে দফ বাজিয়ে গান করছিল। অপর বর্ণনামতে, বালিকারা সেই গান গাচ্ছিল যা আনসারগণ বুয়াস যুদ্ধে প্রেরণা ও উত্তেজনার জন্য গেয়েছিল। তখন নবী (সা.) নিজ কাপড়ে মুখ ঢেকে শুয়েছিলেন।
হযরত আবু বকর (রা.) বালিকাদের ধমক দিলেন। তখন রাসুল (সা.) নিজ মুখ হতে কাপড় সরালেন এবং বললেন, হে আবু বকর! এদের ছেড়ে দাও! (অর্থাৎ করতে দাও)। কারণ এটা ঈদের দিন। অপর এক বর্ণনায় এমনটি রয়েছে, ‘হে আবু বকর! প্রত্যেক জাতির জন্য আনন্দ-উৎসব, এটা আমাদের আনন্দ উৎসবের দিন।’ (মেশকাত : ১৩৪৮)
সাওমের আভিধানিক অর্থ হলো, বিরত থাকা। পারিভাষিক অর্থ হলো, দিনের বেলায় নিজেকে খানাপিনা, সহবাস থেকে নিজেকে বিরত রাখা। সাওম আমাদের উপর ফরজ করা হয়েছে। আল্লাহ ইরশাদ করেছেন বলেন, হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর। (সূরা বাকারাহ- ১৮৪)
রোজা কেবল আমাদের জন্যই ফরজ করা হয়েছে এমন নয়। বরং আমাদের পূর্ববর্তী নবী ও রাসূলদের উম্মাতের জন্যও ফরজ ছিল। তবে আমাদের জন্য এই মাস বিশেষ একটি মাস। কারণ, এই মাসে রবের তরফ থেকে আমাদের বিধান আল-কুরআন নাজিল হয়েছে। মহান আল্লাহ রমজান মাসকে বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানে মহিমান্বিত করেছেন। পবিত্র রমজান মাসের মর্যাদার বর্ণনা এসেছে কোরআন ও হাদিসের অসংখ্য স্থানে।
যারা দিনের বেলায় নিজেকে খাবারদাবার, সহবাস থেকে নিজেকে বিরত রাখে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, তাদের জন্য রয়েছে ১০টি সুসংবাদ।
প্রতিটি নেক আমলের পুরস্কার আছে। তবে রোজাদারের জন্য আল্লাহ বিশেষ পুরস্কার রেখেছেন। হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আদম সন্তানের প্রতিটি আমল তার জন্য, কিন্তু রোজা এর ব্যতিক্রম। কেননা তা আমার জন্য এবং আমিই তার প্রতিদান দেব।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০৪)
আল্লাহ রোজাদারকে ক্ষমা করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানসহ সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা পালন করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করা হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০১)
যারা রোজা রাখে, তারা আল্লাহকে ভালোবাসেন। নিচের হাদিসে সেই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। নবীজি (সা.) বলেন, ‘সেই মহান সত্তার শপথ! যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, অবশ্যই রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিসকের ঘ্রাণের চেয়েও উত্তম।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০৪)
মহান আল্লাহ রমজান মাসে মুমিনের পাপ মার্জনা করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এক জুমা থেকে অন্য জুমা এবং উভয়ের মধ্যবর্তী সময়ের সব গুনাহর জন্য কাফফারা হয়ে যায়, যদি সে কবিরা গুনাহে লিপ্ত না হয়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৩৮)
সাহাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জান্নাতে রাইয়ান নামের একটি দরজা আছে। এই দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন শুধু রোজা পালনকারীরাই প্রবেশ করবে। তারা ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৯৬)
রমজান জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ প্রতিদিন ইফতারের সময় কতিপয় বান্দাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন এবং তা প্রতি রাতেই হয়ে থাকে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৬৪৩)
রমজান হলো মুমিনের আনন্দের মাস। মহানবী (সা.) বলেন, ‘রোজাদারের জন্য আছে দুটি আনন্দ। এক আনন্দ হলো যখন সে ইফতার করে, আরেক আনন্দ হলো, যখন সে তার প্রতিপালকের সঙ্গে মিলিত হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৪৯২)
রমজান মুমিনের দোয়া কবুলের মাস। মহানবী (সা.) বলেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। ন্যায়পরায়ণ বাদশা, রোজা পালনকারী—যতক্ষণ না সে ইফতার করে এবং মজলুম।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৯৮)
মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত, কিয়ামতের দিন সাওম ও কুরআন সুপারিশ করবে। সিয়াম বলবে- ‘হে আমার রব! আমি তাকে দিনে খানাপিনা ও জৈবিক চাহিদা থেকে বিরত রেখেছি। আপনি তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন।’
হাদিস শরীফে এসেছে- যে-ব্যাক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে গিয়ে রোজা রাখবে, আল্লাহ তাআলা তাকে ৭০ বছরের দূরত্বে নিয়ে যান! (সহিহুল বুখারি- ২৮৪০)
মন্তব্য করুন