নীলফামারীর ডিমলায় সাব-রেজিস্টার ও দলিল লেখকের বিরুদ্ধে প্রতারণার মাধ্যমে ভুয়া দলিল রেজিস্ট্রির অভিযোগ উঠেছে। গত ২২ জুন ডিমলার সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে এ ঘটনা ঘটে। একটি জাল-জালিয়াতির চক্র সাব-রেজিস্ট্রার ও দলিল লেখকের যোগসাজশে দাতার নাম ও স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া মালিক সাজিয়ে তিস্তা নদীর চরে ১ হাজার ৩৯ একর জমি হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর প্রতিকার চেয়ে প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছেন ভুক্তভোগী পরিবার। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন তারা।
অনুসন্ধানে, ৫টি অপ্রত্যাহারযুক্ত রেজিস্ট্রি দলিলের খোঁজ মিলেছে। এসব জমির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় শতকোটি টাকা। এ জালিয়াত চক্র প্রকৃত তথ্য আড়াল করে, অসত্য ও ভুয়া তথ্য দিয়ে সাব-রেজিস্ট্রারের সাহায্যে এসব দলিল করেছেন। এসব অপকর্মের সঙ্গে ডিমলা সদর সাব-রেজিস্ট্রার মনীষা রায় জড়িত বলে দাবি ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর।
অভিযোগে বলা হয়েছে, বিএস খতিয়ান জালিয়াতি করে উপজেলার ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের ছাতুনামা মৌজার ১ হাজার ৩৯ একর জমি গত ২২ জুন সফিয়ার রহমান ও শাহ মো. মেহেদী হাসানের নামে ডিমলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে অফিসে ভূমি-রেজিস্ট্রি অপ্রত্যাহারযোগ্য আমমোক্তারনামা দলিল করা হয়। দলিল লেখক মতিউর রহমান চৌধুরীর সম্পাদনায় পাঁচটি দলিলের মাধ্যমে জমি হস্তান্তর হয়। দলিলগুলোতে ডিমলা ও হাতিবান্ধা উপজেলার ২৭ জনকে বিক্রেতা হিসেবে দেখানো হয়েছে।
অভিযোগে আরও বলা হয়, ডিমলার সাব-রেজিস্ট্রার মনীষা রায়ের অনৈতিক যোগসাজশে বিক্রেতারা ওই জমির সর্বশেষ খতিয়ানের মালিক না হওয়া সত্ত্বেও দলিল রেজিস্ট্রি সম্পন্ন করেন।
জমির মালিক মজিবর রহমানসহ অন্যরা দাবি করেন তারা জমি বিক্রি করেননি। অন্য ব্যক্তিদের ভুয়া মালিক সাজিয়ে দলিল সম্পূর্ণ করা হয়েছে। তাদের জাল স্বাক্ষর ও ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার হয়েছে জমির দলিলে। অধিকাংশ দলিলে জীবিত ব্যক্তিদেরও মৃত দেখানো হয়েছে। এখন এসব জমি জমি হারালে পথে বসতে হবে তাদের।
ভুক্তভোগীরা জানান, সম্প্রতি জমি চাষ করতে গেলে তাদের বলা হয় সফিয়ার ও মেহেদি নামের ব্যক্তি সম্পূর্ণ চরের জমি কিনে নিয়েছেন। জমি প্রকৃত মালিকরা তখন জানতে পারেন, তাদের অগোচরে জাল দলিলের মাধ্যমে তাদের বসতবাড়িসহ ফসলি জমি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় চরের প্রায় ২ হাজার পরিবার সর্বস্বান্ত হওয়ার পথে। এ জমিতে চাষাবাদ করেই তাদের সংসার চলে। পরিবার পরিজনসহ কোনোরকমে দিনযাপন করেন।
ভুক্তভোগীতে ভাষ্য মতে, এ এলাকায় জাল দলিলের একটি চক্র সৃষ্টি হয়েছে। চরাঞ্চলের হাজারো পরিবার এ চক্রের প্রতারণার শিকার। প্রতিবাদ করলেই মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। এ জালিয়াতি চক্রের মূলে রয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা দলিল লেখক মতিউর রহমান চৌধুরী ও উপজেলা সাব-রেজিস্টার মনিষা সাহা। মতিউর ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের বাসিন্দা। তিনি দলিল লেখক সমিতির সভাপতি। তবে, যাদের নিকট থেকে এই আমমোক্তারনামা বা পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি নেওয়া হয়েছে তারা বলছেন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে তাদের নিকট থেকে জমি লিখে নেওয়া হয়েছে। তারা কেউ জমির প্রকৃত মালিক নন। এত জমিও তাদের নেই। এ ছাডা স্বাক্ষরকারীদের বড় একটা অংশ জমি কেনাবেচার কিছুই জানেন না। কেউ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসেও যাননি। তাদের নামে জাল স্বাক্ষর করা হয়েছে।
আমমোক্তারনামায় স্বাক্ষর করা বাহাদুর, ছফের আলী, আব্দুল লতিফ, রেজাউলসহ অন্তত ১০ জন বলেন, সফিয়ার ও মেহেদী তিস্তার চরে আমাদের মালিকানা জমিতে সোলার প্যানেল তৈরির জন্য প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবে রাজি হলে তারা জানায় কোম্পানির নিকট জমি বিক্রির আলোচনার জন্য প্রতিনিধি হিসেবে তাদের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিতে হবে। পরে আমরা ১০/১২ জন ডিমলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে শুধু কোম্পানির সঙ্গে আলোচনার জন্য তাদের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়েছি। পরে জানতে পারি তারা প্রতারণার মাধ্যমে আমাদেরসহ অন্যের জমিও লিখে নিয়েছেন। তাদের ইচ্ছেমতো জমির পরিমাণও বসিয়ে দিয়েছেন। এসব জমির মালিক আমরা না।
তারা অভিযোগ করেন, প্রতারণার সঙ্গে ডিমলা সাব-রেজিস্ট্রার মনীষা রায় ও দলিল লেখক মতিউর রহমান চৌধুরী জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের প্রক্রিয়া চলমান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাব-রেজিস্টার মনিষা রায়ের বিরুদ্ধে ইতোপূর্বেও জাল দলিল ও নামজারিতে জমি রেজিস্ট্রির অভিযোগ রয়েছে। যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
স্থানীয়দের ভাষ্য, সাব-রেজিস্ট্রার মনীষা রায়ের সময়ে ডিমলায় জালিয়াতির মাধ্যমে জমি রেজিস্ট্রি বেড়েছে বহুগুণ। চাহিদামতো টাকা দিলেই সব অনিয়ম বৈধ হয়ে যায়। ঘুস ছাড়া এখানে কোনো দলিল রেজিস্ট্রি হয় না।
উপজেলার খড়িবাড়ি এলাকার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন অর রশিদের অভিযোগ, তিনি বর্তমান সাব-রেজিস্ট্রার মনীষা রানীকে তার জমির মূল কাগজপত্র দেখিয়ে রেজিস্ট্রি বন্ধের আবেদন করেন। বিষয়টি তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকেও লিখিতভাবে জানান। কিন্তু সাবরেজিস্ট্রার মনীষা ভুয়া মালিক রঞ্জিত জাল দলিল ও নামজারি দিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করে দেন।
উপজেলার ৫টি গ্রামের অন্তত ২০ জন বাসিন্দা বলেছেন, সাব-রেজিস্ট্রার মনীষার দায়িত্ব পালনকালে গত ২ বছরে জাল দলিল ও জাল নামজারি দিয়ে তাদের জমি বিক্রি করেছে জালিয়াত চক্র।
এ বিষয়ে দলিল লেখক মতিউর রহমান ও ক্রেতা সফিয়ার রহমান বলেন, সাব-রেজিস্টার কাগজপত্র দেখে দলিল রেজিস্ট্রি করেছেন। কাগজপত্র ঠিক না থাকলে জমি রেজিস্ট্রি কিভাবে হলো। সাবরেজিস্ট্রার মনীষা রানী তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখে জমি রেজিস্ট্রি করা হয়। দলিল লেখক মতিউর রহমানের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই দলিলগুলো করা হয়েছে। এখন দাতারা যদি কোনো অভিযোগ দেন তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জেলা প্রশাসক পঙ্কজ ঘোষ বলেন, অভিযোগের কপি এখনও হাতে পাইনি। তিনি বিষয়টি জেনে ব্যবস্থা নিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
মন্তব্য করুন