কোটা ব্যবস্থা বহাল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে আবেদনকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর মধ্যে আহনাফ সাঈদ খান নামে একজন আবেদন থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে আন্দোলনে ফেরার ঘোষণা দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, আন্দোলনে আমার পূর্ণ সমর্থন থাকা অবস্থায় এটা আমি কোনোভাবেই চাইতে পারি না যে, আমার নেওয়া আইনি পদক্ষেপকে আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে। তাই পুরো ঘটনাচক্রের পরিপ্রেক্ষিতে রিট থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ ব্যাপারে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছি।
শুক্রবার (১২ জুলাই) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন আহনাফ।
ফেসবুকে আহনাফ সাঈদ খান লেখেন, ৯ জুলাই আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষার্থী হাইকোর্টের বাতিল করে দেওয়া ২০১৮ সালের পরিপত্রের রায়ের বিপক্ষে আপিল বিভাগে রিট করি। এখানে আমরা আপিল করি ভুক্তভোগী এবং সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি হিসেবে। একই রায়ের বিরুদ্ধে পূর্বে রাষ্ট্রপক্ষের দায়ের করা একটি আপিলের শুনানি হয় গত ৪ জুলাই, যেখানে হাইকোর্টের বাতিল করে দেওয়া পরিপত্রটি স্থগিত না করে পরবর্তী শুনানির জন্য অপেক্ষায় থাকতে বলা হয়। সর্বশেষ ১০ জুলাই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের স্থিতাবস্থা জারি করেন। এখানে একটি বিভ্রান্তি তৈরি হয় যে, আমরা আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে রিটটি করি অথচ আমি নিজে সরাসরি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছি এবং ৫ জুন যখন হাইকোর্ট পরিপত্রটি বাতিল করে তখন থেকেই বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কার চেয়ে আমি কথা বলে আসছি। যদিও আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল আদালতে এ ব্যাপারে যাওয়া হবে না এবং বৈষম্যমূলক কোটার বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ লড়াইটি রাজপথে হবে। এখানে আমি ভেবেছিলাম ভুক্তভোগী কেউ আদালতে যাক কিংবা না যাক আদালতে চলমান আইনি প্রক্রিয়া নিজস্ব গতিতেই চলবে, তাই ভুক্তভোগীরা এখানে আপিল করলে চলমান বিষয়টির আইনি প্রক্রিয়ায় কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের ব্যাপারে একটি শক্তিশালী গ্রাউন্ড তৈরি হবে। পরবর্তীতে আপিল বিভাগের দেওয়া স্ট্যাটাস কো কিংবা স্থিতাবস্থার পর থেকে নানাভাবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে যে, যেহেতু আদালতে সমাধান হয়ে গেছে তাই আর আন্দোলনের কোনো যৌক্তিকতা নেই। অথচ না এখানে হাইকোর্টের পরিপত্র বাতিল করে দেওয়া রায়টি স্থগিত করা হয়েছে, না কোটা ব্যবস্থার কোনো সমাধান হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০১৮-এর পরিপত্র ফিরিয়ে আনা হলেও এখানে কোটা সমস্যার কোনো সমাধান হয় না। কেননা ২০১৮ সালের পরিপত্রেও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কোটা বাতিল কিংবা সংস্কার কোনো কিছুই পরিবর্তন করে পরিপত্রটি জারি হয়নি। ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহাল করা হলেও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক কথা প্রথাটি রয়ে যাচ্ছে। উক্ত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে জনপরিসরে এমন একটি ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, আমাদের দায়ের করা আপিলটির কারণেই আন্দোলন বন্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে, কিংবা আন্দোলনের গ্রাউন্ড নষ্ট করা হয়েছে আমাদের রিট করার মাধ্যমে। সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল কোটা সমস্যার সমাধান আদালতেই হবে, কেননা ব্যাপারটি এখন আদালতে গড়িয়েছে- এখানে সরকারের আর কোনো কিছুই করার নেই।
আহনাফ বলেন, গতকাল হাইকোর্টের দেওয়া গত ৫ জুনের রায়টির একটি অংশ প্রকাশিত হয়েছে সেখানে হাইকোর্ট থেকে বলা হয়েছে, সরকার চাইলে কোটার পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন, সংস্কার কিংবা যে কোনো কিছুই করতে পারে। অর্থাৎ এ মুহূর্তে নির্বাহী বিভাগের এ কথা বলার সুযোগ থাকে না যে, ব্যাপারটি পুরোটাই আদালতের বিচার প্রক্রিয়াধীন, তাই তাদের কিছুই করার নেই। বরং আদালতের মাধ্যমেই এটা স্পষ্ট হয় যে, কোটা ব্যবস্থার পরবর্তী পদক্ষেপ সরকারকেই নিতে হবে। এর ফলে, আন্দোলনকারীদের দাবি অনুযায়ী এ সমস্যার সমাধান যে সরকারকেই করতে হবে এ দাবিটির সম্পূর্ণ যৌক্তিকতা আবারও প্রমাণ হলো। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী হিসেবে এবং আন্দোলনে আমার পূর্ণ সমর্থন থাকা অবস্থায় এটি আমি কোনোভাবেই চাইতে পারি না যে, আমার নেওয়া আইনি পদক্ষেপকে আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে। তাই পুরো ঘটনাচক্রের পরিপ্রেক্ষিতে রিট থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ ব্যাপারে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছি।
আহনাফ সাঈদ খান আরও বলেন, মহামান্য আদালতের রায় অনুযায়ী, কোটা সমস্যা সমাধানের এখতিয়ার সরকারের রয়েছে, তাই ছাত্রসমাজের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে সরকারকেই আন্দোলনকারীদের দাবি অনুযায়ী কোটার যৌক্তিক সংস্কার করতে হবে। আজকে যতদূর অগ্রগতি হয়েছে তা সারা দেশে চলমান আন্দোলনের কারণেই হয়েছে, আন্দোলনই বাংলাদেশকে বারবার পথ দেখিয়েছে, আন্দোলনই কোটা ব্যবস্থার চূড়ান্ত সমাধানের পথ দেখাবে। চূড়ান্ত সমাধানের আগেই আন্দোলন বন্ধ হয়ে গেলে কোটা সংস্কার আর আলোর মুখ দেখবে না। চলমান আন্দোলনের প্রতি আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। আন্দোলনের মাঠ থেকে এর স্থায়ী সমাধান নিয়েই পড়ার টেবিলে ফিরে আসব আমরা।
এর আগে, গত ৯ জুলাই কোটা ব্যবস্থা বহাল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি আল সাদী ভূঁইয়া এবং উর্দু বিভাগের শিক্ষার্থী আহনাফ সাঈদ খান আবেদন করেন। পরে গত ১০ জুলাই সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায়ের উপর স্থিতাবস্থা থাকবে বলে রায় দেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ।
প্রসঙ্গত, সরকারি চাকরির সব গ্রেডে অযৌক্তিক এবং বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ন্যূনতম মাত্রায় (সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ) এনে সংসদে আইন পাসের দাবিতে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করছেন কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা। সারা দেশেই এ আন্দোলন চলছে। গতকাল বিকেলে কেন্দ্রীয়ভাবে রাজধানীর শাহবাগ অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা। এরপর রাত ৯টার দিকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম কর্মসূচি ঘোষণা করে বলেন, সংসদ থেকে কোটার বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসার আগ পর্যন্ত আমরা রাজপথ ছাড়ব না।
মন্তব্য করুন