এমরান সালেহ প্রিন্স
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক। আগামীকাল অনুষ্ঠিত বিএনপির ঢাকা মহাসমাবেশ, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা-
কালবেলা: আগামীকাল অনুষ্ঠিত ঢাকা মহাসমাবেশে বিএনপির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী?
এমরান সালেহ প্রিন্স: আমাদের এক দফা এক দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই আগামীকালকের মহাসমাবেশ। সেই এক দফা দাবি হলো সরকারের পদত্যাগ। আমরা একটি চূড়ান্ত আন্দোলনের মধ্যে রয়েছি। আমাদের এক দফা ঘোষণা করার দিনই জনগণকে আমরা আমাদের বার্তা দিয়ে দিয়েছি এবং জনগণ ও আমাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। এখন এই এক দফা আন্দোলনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই আমাদের লক্ষ্য।
কালবেলা: ২৭ জুলাইয়ে ঘোষিত মহসমাবেশ একদিন পিছিয়ে ২৮ তারিখ নির্ধারণ করেছে বিএনপি। এমন সিদ্ধান্তের পেছনে কারণ কী?
এমরান সালেহ প্রিন্স: একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পুলিশের এ ধরনের হুকুম রাষ্ট্রের জন্যই অসম্মানের। মূলত এটি সরকারেরই হুকুম। সরকার এতটাই জনবিছিন্ন যে তারা বিরোধীদলের কর্মসূচিকে ভয় পায়। এজন্য তারা পুলিশকে দিয়ে এবং তাদের অনুগত প্রশাসনকে দিয়ে দেশের মানুষের এই গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করছে। আমরা ২৭ জুলাই আমাদের মহাসমাবেশ করার জন্য আশা করেছিলাম। নয়াপল্টন অথবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার সিদ্ধান্তটি আমরা পরিষ্কারভাবে জানিয়েছি এবং মানুষের সামনেও এটা ওপেন রেখেছিলাম। এর আগে গত ১০ ডিসেম্বর আমরা নয়াপল্টনে আমাদের বিভাগীয় সমাবেশ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা সেটি করতে দেয়নি এবং তখন সরকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমাদের সমাবেশ করতে বলেছিল। আমরা করিনি নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে।
এমরান সালেহ প্রিন্স: এখন আমরা কোনো বিভাগীয় সমাবেশ নয় বরং বিএনপির মহাসমাবেশ করার জন্য নয়াপল্টন অথবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান চেয়েছিলাম। কিন্তু দুই জায়গার একটিতেও আমাদের সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। আমাদের গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ করতে বলেছে পুলিশ। কিন্তু বিএনপির মহাসমাবেশের মতো একটি সমাবেশ যেখানে ব্যাপক জনসমাগম হবে সেটি এরকম ছোট একটি জায়গায় করা সম্ভব নয়।
কালবেলা: আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কী আপনাদের সহায়তা করছে?
এমরান সালেহ প্রিন্স: বাংলাদেশ কোনো পুলিশি রাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যেটা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা অর্জন করেছিলাম। ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক পথে যাত্রা করেছিল। সেক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক অধিকার সমাবেশ করার জন্য পুলিশের এ ধরনের নির্দেশনা কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। আমরা নিয়ম-নীতি মেনে রাজনীতি করি। আমরা সংঘাত চাই না। আমরা নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে চেয়েছিলাম। ২৭ তারিখ কর্ম দিবস হওয়ার অজুহাতে আমাদের অনুমতি দেওয়া হয়নি। সুতরাং কৌশলগত কারণে আমরা সমাবেশের দিন একদিন পিছিয়ে শুক্রবার সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
পুলিশ যে কারণ দেখিয়ে আমাদের সমাবেশের স্থান পরিবর্তন করতে বলেছিল সেটা হলো কর্ম দিবসে জনদুর্ভোগ। যেহেতু পর দিন শুক্রবার ছুটির দিন। সুতরাং এখানে জনদুর্ভোগের কোনো প্রশ্ন থাকার কথা না। এ কারণেই আমরা ছুটির দিনে নয়া পল্টনেই আমাদের সমাবেশ করছি।
কালবেলা: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগও একই দিন ঢাকায় শান্তি সমাবেশ করবে? একে বিএনপি কীভাবে দেখছে?
এমরান সালেহ প্রিন্স: এটা খুবই হাস্যকর একটি বিষয় যে আওয়ামী লীগের মতো একটি দলের নিজস্ব কোনো কর্মসূচি নেই। বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচির দিনে তারা পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছে শান্তি সমাবেশের নামে। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর সহযোগী যারা ছিল তারাও এরকম শান্তি কমিটির নামে বিভিন্ন জায়গায় শান্তি সমাবেশ করত। তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে আওয়ামী লীগ বিএনপির কর্মসূচির দিনে, জাতির মুক্তির জন্য করা আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য এবং সংঘাত সৃষ্টি করার জন্য পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে উসকানিমূলক শান্তি সমাবেশ দিচ্ছে। এই শান্তি সমাবেশ থেকে তারা বিভিন্ন জায়গায় সংঘাত সৃষ্টি করছে। গত ১৮ জুলাই আমাদের পদযাত্রা কর্মসূচির সময় লক্ষ্মীপুরে সজীব হাসান নামের আমাদের কৃষকদলের একজন কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে এই শান্তি সমাবেশ কর্মসূচির মাধ্যমেই। এর আগে এরকম আরও ১৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এটাই তাদের শান্তি সমাবেশের ফল।
সেজন্য আমরা বলছি, আমাদের এই মহাসমাবেশের দিনে সংঘাত সৃষ্টি করার জন্যই আওয়ামী লীগ আবারও শান্তি সমাবেশের নামে পাল্টা কর্মসূচি দিয়েছে। তারা অশান্তি সংঘাত এবং রক্তপাতের সৃষ্টি করতে চায়। তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়। তারা জনমানুষের আন্দোলনকে ব্যাহত করতে চায়, দমন করতে চায়। কিন্তু এটা এখন আর সম্ভব নয়। এ আন্দোলন আজ জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। জনগণই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে।
কালবেলা: ২০১৪ কিংবা ১৮ সালে আপনারা কয়েকটি দল এক সঙ্গে আন্দোলন করেছিলেন। কিন্তু এখন আপনারা এককভাবে আন্দোলন করছেন। এর মধ্যে আলাদা কোনো বিষয় আছে কী?
এমরান সালেহ প্রিন্স: আমরা এককভাবে আন্দোলন করছি না। আমাদের সঙ্গে জনগণ আছে। আমাদের সঙ্গে অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোও যুগপৎ আন্দোলন করছে। সুতরাং সবাই মিলেই আমরা আন্দোলন করছি। এই দেশটা সবার কিন্তু এই দেশটা এখন খাদের মধ্যে পড়েছে। গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকারকে গুম করে ফেলা হয়েছে। গণতন্ত্র এবং ভোটের অধিকারকে ফিরিয়ে এনে দেশকে রক্ষা করাই আমাদের লক্ষ্য।
যার যার অবস্থান থেকে তারা আন্দোলন করছে। এখন আমরা যুগপৎভাবে আন্দোলন করছি। আমাদের সঙ্গে ডানপন্থি, বামপন্থি সবাই একই দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে। একমাত্র আওয়ামী লীগ ছাড়া সব রাজনৈতিক দল এই সরকারের পদত্যাগ চাচ্ছে। সবাই একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাচ্ছে।
কালবেলা: আপনারা আন্দোলনের মধ্যে রয়েছেন। আলোচনায় বসার কোনো অবস্থান আপনাদের রয়েছে কী?
এমরান সালেহ প্রিন্স: সরকারের সঙ্গে আলোচনায় কোনো লাভ নেই। আমরা ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও আলোচনা করেছিলাম। তখনও প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন—অতীতে যা হওয়ার হয়েছে, আসেন সবাই মিলে একসঙ্গে একটি ভালো নির্বাচন করি, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন তাদের কাজ করবে এবং আমরা নির্বাচন করব। তার সেই আশ্বাসের ওপর বিশ্বাস রেখে আমরা নির্বাচনে গিয়েছিলাম। সেই নির্বাচন কীভাবে হয়েছিল সেটা সবাই জানে। নির্বাচন ব্যবস্থাটাকেই ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে।
সুতরাং এই সরকারের সঙ্গে আলোচনার কোনো মানে হয় না। বর্তমান সরকার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে বড় বাধা। এই সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হচ্ছে সরকারের পদত্যাগ, পার্লামেন্ট বাতিল, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে নির্বাচন। সুতরাং সরকারের পদত্যাগ ছাড়া নির্বাচনের কোনো সুযোগ নেই।
কালবেলা: সরকার পদত্যাগ করে কার কাছে ক্ষমতা দেবে? সেটা নিয়ে কি আলোচনার প্রয়োজন নেই?
এমরান সালেহ প্রিন্স: আমরা আমাদের ১০ দফা দাবিতে উল্লেখ করেছি কীভাবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। তারপরেও বলব—যেহেতু তারাও একটি রাজনৈতিক দল। তারা যদি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের নীতিগত সিদ্ধান্তে একমত হয় তাহলে আমরাসহ সব রাজনৈতিক দল একত্রে বসে একটি ফর্মুলা বের করতে পারি। আমরা আমাদের ১০ দফাতে একটি গাইড লাইন দিয়েছি। আমরা বলেছি তারা যদি পদত্যাগ করতে রাজি হয় তাহলে বসে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
কালবেলা: সমাবেশের পর কী ধরনের কর্মসূচি দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে আপনাদের?
এমরান সালেহ প্রিন্স: সরকার তার অনুগত প্রশাসনকে দিয়ে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে খর্ব করছে। সেই গণতান্ত্রিক অধিকারকে ফিরিয়ে আনার জন্যই আমরা লড়াই করছি। তাই পরবর্তী কর্মসূচির ব্যাপারে এই মুহূর্তে কিছু বলা সম্ভব নয়। এখন আমরা এক দফা আন্দোলনের কর্মসূচিতে রয়েছি এবং এরপর আমরা উদ্ভূত পরিস্থিতির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব। প্রতি মুহূর্তে সংকট আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে, পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে এবং অবনতি ঘটছে। যখন যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে সেই পরিস্থিতির আলোকেই বিএনপির কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। আর দেশে যদি সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয় তার জন্য দায়ী থাকবে আওয়ামী লীগ সরকার।
মন্তব্য করুন