২ অক্টোবর থেকে নানা আনুষ্ঠানিকতায় উদযাপিত হয় ‘বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ-২০২৩। এবারের আয়োজনের প্রতিপাদ্য ছিল ‘শিশুর জন্য বিনিয়োগ করি- ভবিষ্যতের বিশ্ব গড়ি।’ শিশুর জন্য বিনিয়োগ বললেই যে তিনটি বিষয় সবার আগে উঠে আসে, তা হলো প্রথমত, শিশুদের জন্য আমরা কি কি বিনিয়োগ উদ্যোগ হাতে নিয়েছি; দ্বিতীয়ত, উদ্যোগগুলো শিশুর জন্য কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ; এবং তৃতীয়ত, উদ্যোগ বাস্তবায়নে আমরা কতটুকু যত্নশীল– অর্থাৎ, বিনিয়োগ উদ্যোগটি আমরা কত সুচারুভাবে বাস্তবায়ন করতে পারছি এবং এ উদ্যোগ থেকে কোন শ্রেণির শিশু কীভাবে উপকৃত হচ্ছে? এই প্রশ্ন তিনটির উত্তরগুলো যদি আমরা ঠিক ঠিকভাবে পেতে পারি, তাহলেই আমরা বুঝব আমরা ভবিষ্যতের বিশ্ব গড়ার সঠিক পথে হাঁটছি।
শিশু অধিকার বিষয়ে বাংলাদেশের নীতিগত অবস্থান অনেক আগে থেকেই পরিষ্কার। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে অনুসমর্থন করে। জাতীয় নীতি বিবেচনায় ২০১১ সালে জাতীয় শিশুনীতি গঠন করা হয়, যার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশে সাত কোটি শিশুর অধিকার সম্পর্কিত উদ্যোগ ও বিনিয়োগগুলো। জাতীয় শিশুনীতির পাঁচটি মূলভিত্তি হলো (১) বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, (২) শিশু দারিদ্র্য দূরীকরণ, (৩) শিশুর প্রতি সকল প্রকার সহিংসতা ও অসমতা নির্মূল করা, (৪) মেয়ে শিশুর প্রতি সকল সহিংসতা ও অসমতা দূর করা এবং (৫) শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ ও সামগ্রিক সুরক্ষা আলোচনায় শিশুর অংশগ্রহণ নিশ্চিত এবং তাদের মতামত গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করা। পরবর্তীতে শিশু অধিকার বাস্তবায়নে সরকার শিশু আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করে।
শিশু অধিকার আলোচনায় যে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গগুলো উঠে আসে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- শিশুর বেঁচে থাকার অধিকার, বিকাশের অধিকার, সুরক্ষার অধিকার ও মত প্রকাশের অধিকার। শিশুর বেঁচে থাকার অধিকারের সাথে প্রাসঙ্গিক যেমন শিশুর স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, চিকিৎসা, বাসস্থান ও জলবায়ুর প্রভাববিষয়ক আলোচনা, তেমনি বিকাশের অধিকার বলতে বুঝি শিশুর শিক্ষা, দক্ষতা ও উপযুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্র তৈরি করা। শিশুর ভৌগোলিক, সামাজিক ও আর্থিক অবস্থান, লিঙ্গ, বয়স, শ্রেণি, গোষ্ঠী, ধর্ম, বর্ণ, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা ও পারিপার্শ্বিকতা নির্বিশেষে শিশুর আছে সব ধরনের সুযোগ ও সুরক্ষা পাবার অধিকার। শিশু অধিকার বাস্তবায়নে আমাদের দরকার স্বল্প- মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন।
শিশু অধিকার বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ সাফল্য দাবি করতেই পারে। এর মধ্যে শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার কমিয়ে আনা, সার্বজনীন টিকা কর্মসূচি, বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষায় সার্বজনীন অংশগ্রহণ, জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠা করা অন্যতম। শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আবার এর বৈপরীত্যও আছে। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা যেমন সবক্ষেত্রে সবশেষ শিশুটির কাছে পৌঁছেনি– বাড়িয়েছে গরিব জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা খরচ, আছে নিরাপদ প্রসূতির অভাব, তেমনি আছে গ্রামাঞ্চলে শিশু চিকিৎসকের অভাব। শিক্ষা ক্ষেত্রে শিশুর একটি বড় অংশ সরকারি প্রাথমিকে যাচ্ছে না শিক্ষার মানের অভাবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আর এনজিওগুলো এক্ষেত্রে যার যার অবস্থানে উদ্যোগী আছে। তবে বেসরকারি স্কুলগুলোতেও শিক্ষার মান নিশ্চিত করা যায়নি। একেবারে প্রাক-প্রাথমিক থেকে পাঠ্যক্রম নিয়েও আছে বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। শিক্ষানীতির অনেকাংশের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন হয়নি। প্রযুক্তি ব্যবহারে মেয়ে শিশুরা পিছিয়ে আছে– দূরশিক্ষা কার্যক্রমও সফলতার মুখ দেখছে না। দারিদ্র্য আর সমাজ সংস্কৃতির বেড়াজালে, উপযুক্ত উদ্যোগ আর সংস্কারের অভাবে স্কুল থেকে ঝরে পড়াও কমানো যাচ্ছে না। কমছে না বাল্যবিয়েও। এখনো বাংলাদেশে প্রতি দুইজনে একজন মেয়েশিশুর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ১৮ বছর পূর্ণ হবার আগেই। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭ এবং তদসংক্রান্ত বিধিমালা, ২০১৮ করেও কমানো যাচ্ছে না এ সমস্যা। কোভিড এ সমস্যাকে ঘনীভূত করেছে বহুমাত্রায়। শিশুকে তার আলোকিত ভবিষ্যতের স্বপ্নটি না দেখাতে পারলে, তাকে উপযুক্ত পরিবেশটা না দিলে, তাকে পরিপূর্ণ বিকশিত হবার সুযোগটি দিতে না পারলে আমাদের এই বিনিয়োগ সফল হবে কীভাবে?
শিশুর বিকাশে শহরাঞ্চলে খেলার মাঠ অপ্রতুল আর গ্রামাঞ্চলে রয়েছে খেলাধুলার সরঞ্জাম আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাব। মেয়ে শিশুর স্কুলে বা খেলতে যাবার পথটিও সবসময় মসৃণ নয়। দেশে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বিশদ কর্মপরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু শিশুর প্রতি সহিংসতারোধে উদ্যোগগুলো খুব একটা কার্যকর হচ্ছে, পত্রিকার পাতা আর পরিসংখ্যান দেখলে কিন্তু তা বলা যাবে না। এটা বলতে হবে যে, শিশু সুরক্ষায় ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায়, শিশুর প্রতি বিনিয়োগে, আমাদের পথচলা বাকি আছে অনেক।
অতি সম্প্রতি কোভিড ও তৎপরবর্তী রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে উসকে দেওয়া মূল্যস্ফীতি আর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নতুনভাবে দরিদ্র হওয়া আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে শিশু অধিকার কার্যক্রম বাস্তবায়নে। ফলস্বরূপ বেড়েছে শ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক শিশুশ্রমবিষয়ক জরিপ প্রতিবেদন মতে, শ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা বর্তমানে ১৮ লাখের বেশি, আর শহরে পথশিশুর মোট সংখ্যাটা তো আমরা সঠিকভাবে জানিই না। সূত্রমতে, পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ছয় লাখ হতে পারে। এসব শিশুর জন্য আমরা কতটুকু বিনিয়োগ করছি?
এখন দেখি, আমরা শিশুর জন্য আসলেই বিনিয়োগ করছি কতটুকু। শিশুর প্রতি স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার প্রতিফলন বুঝতে চোখ রাখা যেতে পারে জাতীয় বাজেটে। আমাদের সামাজিক খাতে বিনিয়োগ একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আটকে আছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে মোট জাতীয় বাজেটের ১১.৬ শতাংশ (তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অংশ বাদ দিয়ে)। আর স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ মোট বাজেটের প্রায় ৫ শতাংশ। নিম্ন আয়ের অথবা মধ্যম আয়ের দেশ, স্বল্পোন্নত দেশ কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার দেশ– কোনো বিবেচনাতেই এই বিনিয়োগ অংশকে গড়মানের আশপাশেও বলা যাবে না। প্রমিত পরিকল্পনায় শিক্ষায় বরাদ্দ ২০ শতাংশ আর স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের অন্তত ১৫ শতাংশ বিবেচনা করা যেতে পারে।
একটি দেশের সরকারের সে দেশের শিশুদের নিয়ে কী বিনিয়োগ ভাবনা, তার একটি নিয়মতান্ত্রিক নির্দেশনা পাওয়া যায়, যদি জাতীয় বাজেটে শিশুকেন্দ্রিক উদ্যোগ, প্রকল্প ও পরিকল্পনাগুলো আলাদাভাবে প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের একটি দারুণ উদ্যোগ ছিল ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো এ রকম একটি আলাদা শিশুকেন্দ্রিক বাজেট পরিকল্পনা প্রণয়ন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারের ১৫টি মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর তাদের শিশুর সাথে যুক্ত কাজগুলোকে আলাদাভাবে রিপোর্ট করে। পাঁচ বছর চলা এ উদ্যোগ ২০১৯-২০ অর্থবছরের পর এখন আর চলমান নেই। ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত প্রকাশিত শিশু বাজেট প্রকাশনায় আমরা দেখি, জাতীয় বাজেটের ১৫.৩ শতাংশ বরাদ্দ ছিল শিশুকেন্দ্রিক কার্যক্রমে। সরকারের মধ্যমেয়াদি লক্ষ্য ছিল ২০২০ সালের মধ্যে এই হার ২০ শতাংশে নিয়ে যাবার– যা অর্জন সম্ভব হয়নি। সেভ দ্য চিলড্রেন ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৫টি মন্ত্রণালয়ের শিশুকেন্দ্রিক কার্যক্রমগুলো বিশ্লেষণ করে দেখেছে, বর্তমানেও এই হার ১৫ শতাংশের আশপাশেই আছে। ২০২০ সালের অনুমিতি ব্যবহার করলে বর্তমানে এই বিনিয়োগের হার পাওয়া যায় জাতীয় বাজেটের প্রায় ১৪.৯ শতাংশ।
শুধু শিশুকেন্দ্রিক বাজেটের (যা মোট জাতীয় বাজেটের প্রায় ১৫ শতাংশ) খাতভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, শিক্ষা খাতে এই বিশেষ বাজেটের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বরাদ্দ থাকে। অর্থাৎ, শিশুকেন্দ্রিক বাজেটের একটা বড় অংশই আবর্তিত হয়েছে শিক্ষা সংক্রান্ত কার্যক্রমকে ঘিরে। শিশু বাজেটে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কার্যক্রমে প্রায় ২০ শতাংশ ও শিশুর সামাজিক সুরক্ষায় ১৪ শতাংশ বাজেট বরাদ্দ এটাই বোঝায়, শিশু স্বাস্থ্য ও শিশু সুরক্ষায় আমাদের আরও অনেক কাজ করা বাকি আছে।
আমরা যদি আমাদের জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা বাজেটের দিকে তাকাই, যেখানে ২৫টিরও বেশি মন্ত্রণালয় ও সংস্থার বাস্তবায়নে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচির পরিকল্পনা থাকে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে সরকার এতে অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের জন্য ভাতার হার এবং সর্বোপরি এর আওতায় প্রায় ১২০টি কর্মসূচির অনেকটিতে বরাদ্দ ও আওতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। শিশুদের সরাসরি কাজে আসে এ রকম ১৬টি কর্মসূচিতে সরকারের এ বছর বাজেট বরাদ্দ ৭,৬৬৪ কোটি টাকা, যা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে মোট বরাদ্দের মাত্র ৬.১ শতাংশ। এর একটি বড় অংশ বিভিন্ন পর্যায়ে স্কুলের শিশুদের উপবৃত্তির কাজে ব্যবহার হবে– যা শিশুদের স্কুলে ধরে রাখার জন্য একটি চলমান ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এই পরিকল্পনায় পথশিশু, বা শ্রমে নিয়োজিত শিশু বা অনাথ ও দুস্থ শিশুর জন্য যে পরিকল্পনা রয়েছে, তার আওতা বা বরাদ্দ দুটোই প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের জন্য নেওয়া কর্মসূচির আওতায় সুবিধা পাবে মাত্র ১ লাখ শ্রমে নিয়োজিত শিশু, আর পথশিশুর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে আছে মাত্র ১,০০০ পথশিশু।
যদি শিশুর প্রতি বিনিয়োগে সামনের দিকে তাকাই, এটা ভবিতব্য যে, নবম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (২০২৬-৩০) মতো মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনায় শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ থাকা জরুরি। শিশুদের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগ, কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে এবং তা দক্ষতার সাথে বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রয়োজনীয় অর্থায়ন নিশ্চিত করতে রাজস্ব আহরণের আওতা বাড়াতে উদ্যোগী হতে হবে। এসব নীতি আলোচনায় শিশুর অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ ও মতামত নেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই আমরা আশা করতে পারি, এমন একটি সমাজ, যেখানে পাঁচ বছরের নিচে আর একটি শিশুও প্রতিরোধযোগ্য রোগে মৃত্যুবরণ করবে না, সব শিশু মানসম্পন্ন মৌলিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবে, এবং সব শিশু থাকবে সুরক্ষিত। যোগ্য হাতে তারাই এগিয়ে নেবে আজকের বাংলাদেশকে। আমরা তো এ রকমই বাংলাদেশ চাই।
জাফর সাদিক: শিশুর প্রতি বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন