ব্যথা শব্দটি আমাদের সবার জীবনে কমবেশি পরিচিত। তবে কিছু ব্যথা আছে, যা শুধু শারীরিক কষ্টই দেয় না, দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকেও প্রভাবিত করে। তার মধ্যে অন্যতম এবং সবচেয়ে প্রচলিত হলো কোমর ব্যথা। দীর্ঘ সময় ধরে ভুল ভঙ্গিতে বসা, একটানা ডেস্কে কাজ করা, কিংবা হঠাৎ ভারী জিনিস তোলায় শুরু হতে পারে কোমরের অসহনীয় যন্ত্রণা।
বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে প্রায় ৯০% মানুষ জীবনের কোনো না কোনো সময়ে কোমর ব্যথায় ভোগেন। এটি যেন এক নীরব মহামারি, যা ধীরে ধীরে আমাদের কর্মক্ষমতা, মানসিক প্রশান্তি এবং দৈনন্দিন গতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ভুল বসার ভঙ্গি, অনুপযুক্ত চেয়ার, শরীরচর্চার অভাব—এসবই এর মূল কারণ।
আরও পড়ুন : কিডনি ভালো না থাকলে শরীর যেভাবে সিগন্যাল দেয়
আরও পড়ুন : হাঁটার সময় ভুল করছেন না তো? এই নিয়মগুলো জানতেই হবে
তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, অনেকেই সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নেওয়ার কারণে এই ব্যথাকে দীর্ঘমেয়াদি করে ফেলে। সচেতনতা ও সঠিক যত্নেই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
বিশ্বজুড়ে কোমর ব্যথা চিকিৎসকের কাছে আসার অন্যতম প্রধান কারণ। গবেষণায় দেখা গেছে, ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ জীবনে একবার হলেও কোমর ব্যথায় ভুগেছেন। বিশেষ করে যারা দীর্ঘক্ষণ একই ভঙ্গিতে বসে থাকেন বা ভুল ভঙ্গিতে বসেন, তাদের এই সমস্যা বেশি হয়।
১. ডিস্ক সরে যাওয়া (Disc Prolapse)
মেরুদণ্ডের ছোট ছোট ডিস্ক যদি সরে যায় বা ফেটে যায়, তাহলে তা স্নায়ুর ওপর চাপ দেয় এবং তীব্র ব্যথার সৃষ্টি করে। এতে পায়ে ব্যথা, ঝিমঝিম ভাব বা দুর্বলতা দেখা দিতে পারে।
২. মাংসপেশিতে টান ধরা (Muscle Strain)
ভুলভাবে বসা, হঠাৎ ভারী কাজ করা বা আঘাত পেলে পেশিতে টান পড়ে, যার ফলে কোমরে ব্যথা এবং ফোলা অনুভূত হয়।
৩. জয়েন্ট ক্ষয় বা অস্টিওআর্থ্রাইটিস (Osteoarthritis)
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেরুদণ্ডের জয়েন্টের কার্টিলেজ ক্ষয় হয়, যা সকালবেলা হাড়ের জয়েন্টে শক্ত অনুভূত এবং চলাচলে ব্যথার কারণ হতে পারে।
৪. স্পাইনাল স্টেনোসিস (Spinal Stenosis)
মেরুদণ্ডের ভেতরের রাস্তা সংকীর্ণ হলে স্নায়ুর ওপর চাপ পড়ে, যা হাঁটার সময় ব্যথা এবং পায়ের দুর্বলতা সৃষ্টি করে।
৫. হাড় দুর্বল হয়ে যাওয়া বা অস্টিওপোরোসিস (Osteoporosis)
হাড় পাতলা ও দুর্বল হলে সহজেই ভেঙে যেতে পারে, যা কোমর বা পিঠে তীব্র ব্যথার কারণ হয়।
কোমর ব্যথার চিকিৎসা নির্ভর করে ব্যথার কারণ ও তীব্রতার ওপর। সঠিক কারণ জানা থাকলে ঘরোয়া চিকিৎসা, ফিজিওথেরাপি এবং প্রয়োজনমতো ওষুধের মাধ্যমে অধিকাংশ রোগী সুস্থ হতে পারেন।
১. ঘরোয়া চিকিৎসা
প্রথম ৫-৭ দিনে বরফ বা গরম প্রয়োগ করে ব্যথা কমানো যেতে পারে। তবে সম্পূর্ণ বিশ্রাম না নিয়ে যতটা সম্ভব হালকা কাজ চালিয়ে যাওয়া উচিত। বুকের নিচে বালিশ দিয়ে শুয়ে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন : ফ্যাটি লিভার থেকে বাঁচতে চাইলে এখনই বদল আনুন জীবনধারায়
আরও পড়ুন : শরীরের ৯ লক্ষণে বুঝবেন অতিরিক্ত চিনি খাচ্ছেন কিনা
২. ওষুধ
- ডাক্তার আপনার ব্যথার মাত্রা অনুযায়ী ওষুধ দিতে পারেন, যেমন:
- ব্যথানাশক (আইবুপ্রোফেন, প্যারাসিটামল)
- পেশি শিথিলকারী (মাংসপেশির টান কমাতে)
- কর্টিকোস্টেরয়েড ইনজেকশন (প্রদাহ কমাতে)
- দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে ওপিওড বা বিশেষ কিছু অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস।
৩. ফিজিওথেরাপি
ফিজিওথেরাপি হলো সবচেয়ে কার্যকর ও নিরাপদ চিকিৎসা, যেখানে বিশেষ ব্যায়াম, হাতের মাধ্যমে থেরাপি, টেপিং, নিডলিং ইত্যাদি প্রয়োগ করা হয়। এর ফলে পেশি মজবুত হয়, ব্যথা কমে এবং পুনরাবৃত্তি রোধ হয়।
৪. বিশেষ পদ্ধতি ও সার্জারি
যদি উপরের চিকিৎসায় ব্যথা কমে না, তবে কর্টিসোন ইনজেকশন, এপিডুরাল ইনজেকশন, রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি নিউরোটমি, কিংবা নিউরোস্টিমুলেশন ডিভাইস ব্যবহার করা হতে পারে। গুরুতর ক্ষেত্রে ডিস্কেক্টমি বা স্পাইনাল ফিউশন সার্জারি প্রয়োজন হতে পারে।
নিয়মিত ব্যায়াম ও স্ট্রেচিং করুন– কোমরের পেশি মজবুত হবে।
সঠিক ভঙ্গিতে বসুন ও দাঁড়ান– ভুল ভঙ্গি ব্যথার বড় কারণ।
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন– অতিরিক্ত ওজন চাপ বাড়ায়।
ভারী জিনিস তুলতে হাঁটুর সাহায্য নিন– পিঠে চাপ কমবে।
দীর্ঘ সময় এক জায়গায় বসে থাকবেন না – মাঝে মাঝে হাঁটুন বা ভঙ্গি বদলান।
আরও পড়ুন : উপুড় হয়ে ঘুমান? জানুন এতে শরীরে কী হয়
আরও পড়ুন : হঠাৎ শরীর ফুলে যাচ্ছে? হতে পারে ভেতরে লুকানো বড় কোনো সমস্যা
কোমর ব্যথা খুবই সাধারণ, কিন্তু অবহেলা করলে জীবনযাত্রায় বড় অসুবিধার কারণ হতে পারে। সঠিক কারণ বুঝে, সময়মতো চিকিৎসা নিয়ে এবং নিয়মিত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলে এই ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আপনার কোমরের যত্ন নিন, সুস্থ থাকুন, ব্যথামুক্ত জীবন উপভোগ করুন।
সূত্র: দ্য আর্জেন্সি রুম
মন্তব্য করুন