মাহমুদ রেজা চৌধুরী
প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০২৪, ০১:৩৪ এএম
আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২৪, ০১:৩৬ এএম
অনলাইন সংস্করণ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের দিন

রাজধানীর শাহবাগে ছাত্র-জনতার বিজয়োল্লাস। ছবি : সংগৃহীত
রাজধানীর শাহবাগে ছাত্র-জনতার বিজয়োল্লাস। ছবি : সংগৃহীত

আমি বিজয় দেখছি: পাঁচ আগস্ট, ২০২৪ বাংলাদেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের দিন। ইতিহাসে তাই লেখা হোক। লেখা হোক, ‘রাজনৈতিক রাজাকারদের’ পরাজয় হয়েছে। বিজয় ছিনিয়ে এনেছে সেই রাজাকারদের হাত থেকে নতুন প্রজন্মের নতুন মুক্তিযোদ্ধা- ছাত্র-জনতা।

কোনো রাজনৈতিক দলের এ ব্যাপারে কোনো কৃতিত্ব নেই। কৃতিত্ব পুরোটাই ছাত্র-জনতার। শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তিনি কখনো পালিয়ে যান না! তার অনেক সমর্থক বলতেন, শেখ হাসিনাকে সরাবার ক্ষমতা কারো নেই। এখন আর এসব ব্যাখ্যা করর প্রয়োজন নেই। ক্ষমতাবান সে যেই হোন না কেন, তাকে উঠাতেও পারে সাধারণ জনতা, নামাতেও পারে তারা। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সেই ইতিহাসের পুনরুদ্ধার হলো বা পুনরাবৃত্তি ঘটল।

কোনো একজন দার্শনিক বলেছিলেন, ছোট্ট এক ফোঁটা পানিতেও বন্যা হতে পারে। পানির ফোঁটা যদি কোনো পিঁপড়ার গর্তে গিয়ে পড়ে। ক্ষমতাবান, স্বৈরাচার শক্তিকে আমরা যতই দুর্বার, দুর্বিনীত মনে করি না কেন! তারা আসলে একটা পিঁপড়ার গর্তেই বসবাস করেন। ওখানে এক ফোঁটা পানিতে বন্যা হতেও পারে। প্রমাণ তো হয়ে গেল, ৫ আগস্ট, ২০২৪. সুরক্ষিত এবং কঠিন প্রাচীর দিয়ে ঘেরা, ‘গণভবন’। এই গর্ত থেকে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করে চলে যেতে হয়েছে দেশের বাইরে। দেশের কোথাও তার স্থান হলো না।

এই মুহূর্তে বিস্তারিত কিছু লেখার নেই। এর আগে লিখেছি (৪ জুলাই) প্রতীক্ষা রাত পোহাবার। এখন প্রতীক্ষা আরেকটু লম্বা সময়ের। মুক্তির যে আলো ছাত্র-জনতা ওদের বুকের রক্ত দিয়ে ছিনিয়ে এনেছে। এখন এই নতুন ক্ষমতা কীভাবে কার হাতে যায়। বুঝতে একটু সময় লাগবে। আপাতত দেখা গেছে দেশের সেনাবাহিনী এ ক্ষমতার অগ্রভাগে আছেন। সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি ইতোমধ্যে কিছু রাজনৈতিক দল এবং সমাজের গুণী কয়েকজন ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কথাও বলেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে হয়তো তারা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বসবেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপকাঠামো নিয়ে, আলাপ করতে।

আপাতত আমাদের প্রতীক্ষা থাকবে, আগামী কয়েক দিনে দেশে কি ঘটে তা দেখা। হাসিনা-উত্তর সরকার প্রধান কে হন। কীভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনা করবেন, কারা থাকবেন এর নেতৃত্বে! এ মুহূর্তে আগাম কিছু বলা যাচ্ছে না। বলা ঠিক হবে না। ছাত্র, জনতা আমরা সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করব সামনে কি ঘটে তাই দেখতে।

তবে একজন অতি সাধারণ নাগরিক হিসেবে আশা করি- বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত- এদের কেউ যেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে না থাকেন। আগামীতে দেশের সাধারণ নির্বাচন যখন হবে তখন তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জনগণের রায় নিয়ে যদি আসতে পারেন তখন দেখা যাবে। তবে আপাতত না। কারণ উল্লেখিত দলগুলো পরীক্ষিত, তারা জনগণের বন্ধু না। দলের ও দলীয় নেতা-নেত্রীর বন্ধু। ভবিষ্যতে এরকম কোনো নেতা আমরা আশা করি না। নেতা তিনিই হবেন, যার কাছে সবার আগে থাকবে দেশ। সবার আগে অগ্রাধিকার পাবে মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য বাস্তবায়ন ও প্রতিষ্ঠা করা।

অনেকে প্রশ্ন করেছেন, আগামীতে যদি কোন সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, আওয়ামী লীগ দল হিসেবে সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে কিনা! এমনকি শেখ হাসিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন কিনা। এ মুহূর্তে এটা বলাও সমীচীন না। তিনি মাত্র তো গেলেন। শোনা গেছে, তাকে নাকি কলকাতা বিমানবন্দেরও নামতে দেওয়া হয়নি। পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী নাকি অ্যালাউ করেননি। তিনি দিল্লি হয়ে লন্ডনের পথে যাত্রা করেছেন। এ খবরের কোনো শতভাগ নিশ্চয়তা এ মুহূর্তে নেই।

শেখ হাসিনার ভবিষ্যৎ কি, সেটাও এখন বলা যায় না। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। সারা দেশে ছাত্র, জনতা এখনো বিজয়ের আনন্দ-উল্লাসে মেতে আছে। এই আনন্দ ও বিজয়ের রেজাল্ট যেন কোনো নতুন শত্রুর হাতে গিয়ে না পড়ে! একাত্তরে আমাদের বিজয়ের পরপরই আমরা যে ভুলগুলো করেছিলাম, ২০২৪-এ ছাত্র-জনতার আজকের এ বিজয়ের পর সে একই ভুল যেন আমাদের দ্বারা না হয়। আমরা তো দেখলাম, দেশের সাধারণ মানুষ একত্রিত হলে তাদের কোনো সামরিক ট্যাংক, পুলিশের গুলি বা কারফিউ দিয়েও আটকানো যায় না। আমরা দেখলাম, সাধারণ মানুষের চাহিদা কি বলে, কি আশা করে তাদের নেতৃত্বের কাছে, সরকারের কাছে।

আমাদের মধ্যে অনেকে এটাকে ‘ভূ-রাজনীতি’ বলেও ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছেন। তারা তাত্ত্বিক শ্রেণির মানুষ। জ্ঞানী, বুদ্ধিমান মানুষ। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শব্দের আড়ালে তারা মূল শক্তিকে খাটো করে দেখতে চান। ভূ-রাজনীতি বলি বা বিশ্ব রাজনীতি, বা ভারত রাজনীতি। এ সব কিছুর আগে জনতার রাজনীতি। তারাই পারেন, দিনকে রাত করে দিতে। অতএব গ্রাউন্ডে এসে যেন আমরা কথা বলি। ঘরে বসে টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে বা সেমিনারে বক্তৃতা দেওয়ার সঙ্গে প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবতার মিলের কোনো নিশ্চয়তাও নেই। বাস্তবতাকে বাস্তবতা দিয়েই শুধু বুঝতে হয়। ‘ভূ-রাজনীতি’ এ কথার তাত্ত্বিকতা যত যৌক্তিক হোক না কেন, বাস্তবতা ভিন্ন হতেও পারে।

কোনো তত্ত্ব হাজির করে, বাস্তবতা নিয়ে যেন আগাম কোনো সন্দেহ বা ভুল হিসাব না করি। মুক্ত মানুষের মনকে যেন বন্দি না করি কোনো নির্দিষ্ট ফ্রেমে। সমাজের বুদ্ধিজীবীরা অধিকাংশ সময় সমাজকে বিভ্রান্ত করেন তাদের তাত্ত্বিক জ্ঞান দিয়ে।

আমাদের মতো অতি সাধারণ মানুষ এসবে অনেক সময় ‘বিভ্রান্ত’ হই। সাধারণ মানুষদের এ ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে আবারও। সরলে গরলতা নয়, গরলকে সরলভাবে গ্রহণ করে আমরা সম্মুখে এগিয়ে যাব সততা ও ন্যায়-নীতি দ্বারা। নতুন বাংলাদেশ সেই স্বপ্নের প্রতীক্ষায় আমাদের অনুপ্রাণিত করুক।

‘আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে, বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার-ভাঙা কল্লোলে’- এই কল্লোলে কোকিলের সঙ্গে কাক যেন আর না আসতে পারে। চেষ্টা হয়েছিল আমাদের নবীন ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনে সে রকম কাকের সংখ্যা বাড়াতে। সফল হয়নি। আমাদের বর্তমান নবীন ওরা কোকিলের সংখ্যা বাড়াতে পেরেছে। তাই ছাত্র-জনতার একটা ‘অপেক্ষাকৃত’ শান্তি প্রিয় আন্দোলনে কোনো রকম রাজনৈতিক দলের প্ররোচনা বা বাইরের কারোরই হস্তক্ষেপ ছাড়াই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে ওরা আবার ছিনিয়ে এনেছে রক্ত লাল, রক্ত লাল সূর্যের উদয়কে ডেকে।

মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ আমাদের দেশকে হেফাজত করুন। আমাদের নিজেদের চরিত্র এবং দেশপ্রেমকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে ধরে রাখায় সাহায্য করেন। কোনো ব্যক্তি বা কোনো দল যেন আমাদের কাছে কোনোভাবেই আর অগ্রাধিকার না পায়। আমাদের দেশের মালিক এই দেশের সাধারণ জনতা। দেশের তরুণ সমাজ। শ্রমিক, মেহনতি মানুষ। আদর্শ শিক্ষক। দেশপ্রেমিক সৈনিক। সবক্ষেত্রে তারা।

অপেক্ষার দ্বিতীয় প্রহর এ মুহূর্ত থেকে শুরু। বলেছিলাম উইকেট মাত্র একটা। কয় বলে সেটা পড়ে দেখার বিষয়। গতকালকের ‘এক’ (একটা লংমার্চ) বলেই সেটা পড়ে গেছে। এখন নতুন দল ব্যাটিংয়ে মাঠে। দেখা যাক, কে বিজয়ী হয়। জনতা নাকি পুরনো কোন শত্রু- নতুন মুখোশে! ৫ আগস্ট, ২০২৪ আমরা যে বিজয় দেখেছি এ বিজয়ই চিরস্থায়ী হোক। নতুন বাংলাদেশ সব রকমের সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে থাকুক।

মাহমুদ রেজা চৌধুরী: লেখক, গবেষক

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হাতিয়ায় ৪টি মাছ ধরার ট্রলারডুবি, ৩০ জেলে নিখোঁজ 

খাগড়াছড়িতে আহত তানজিনের পাশে দাঁড়ালেন বিএনপি নেতা

আ.লীগের পরিকল্পনায় গার্মেন্টসে বিক্ষোভ-ভাঙচুর হয়েছে : রাশেদ প্রধান 

শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংলাপ / জবিতে আয়োজিত হতে যাচ্ছে ‘কেমন বিশ্ববিদ্যালয় চাই’

গাড়িবহরে হামলায় স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নেতা নিহত

জনগণের মালিকানা ফিরিয়ে দিতে চাই : বিএসপিপি

জয়পুরহাটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মতবিনিময় সভা

দেশ এখনো স্থিতিশীল নয় : এবি পার্টি

ইসরায়েলের সেনাপ্রধানের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত

অসীম আত্মত্যাগে অর্জিত স্বাধীনতা ব্যর্থ হতে পারে না : আমিনুল হক

১০

ফ্যাসিস্ট দোসরদের বিষদাঁত ভেঙে দিতে হবে : সাকি

১১

পাহাড়ি ভাতা মূল বেতনের সমপরিমাণ করার প্রস্তাব

১২

কামারখন্দে গাম্বুরা ভাইরাসে মারা গেল ৫ হাজার মুরগি

১৩

আখাউড়া স্থলবন্দরে কমেছে রপ্তানি বাণিজ্য

১৪

বিএন‌পি নেতা দুলালের ব‌হিষ্কার আদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে মানববন্ধন

১৫

অচল হয়ে পড়েছে কক্সবাজারের চিকিৎসা সেবা

১৬

গণহত্যাকারী শেখ হাসিনার ক্ষমা নেই : প্রিন্স

১৭

জাতির ঐক্য বিনষ্টের চক্রান্ত চলছে : মির্জা ফখরুল

১৮

ক্র্যাবের প্রতিবাদ ও নিন্দা / সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাও হত্যা মামলা

১৯

ছায়ানটে শ্রোতার আসরে মনোমুগ্ধকর ১৬টি রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনা

২০
X