২৬ জুলাই ২০২৩, নিজের রক্ষী বাহিনীর এক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজারের পশ্চিমাপন্থি প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বাজোম। অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া প্রেসিডেন্সিয়াল গার্ড বাহিনীর প্রধান জেনারেল আব্দুর রাহমান চিয়ানি নিজেকে নাইজারের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ঘোষণা করেছেন এবং ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বাজোমকে গৃহবন্দি রাখা হয়েছে।
অভ্যুত্থানের পরপরই দ্রুত এবং ব্যপক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। ফ্রান্সের নেতৃত্বে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নাইজারকে নিরাপত্তা সহযোগিতা ও আর্থিক সহায়তা স্থগিত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বাজোমকে সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও একসময় নাইজারে উপনিবেশ স্থাপন করা ফ্রান্স এত দিন মোহাম্মদ বাজোমকে সরাসরি সহায়তা করে আসছিল। নাইজারে এই দুই দেশের সেনাঘাঁটি রয়েছে।
মোহাম্মদ বাজোমকে ক্ষমতায় ফেরানোর লক্ষ্যে অভ্যুত্থানকারীদের সাথে আলোচনা করতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড যিনি ২০১৪ সালে ইউক্রেনসহ বিশ্বজুড়ে বেশ কয়েকটি মার্কিন-সমর্থিত অভ্যুত্থানের প্রধান পরিকল্পনাকারী তিনি উড়ে এসেছিলেন নাইজারে। কিন্তু তিনি স্বীকার করেছেন, নতুন সামরিক শাসনের সাথে তার কথোপকথনে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
পশ্চিমাপন্থি পশ্চিম আফ্রিকার ১৫টি দেশের জোট দ্য ইকোনমিক কমিউনিটি অব ওয়েস্ট আফ্রিকান স্টেটসের (ইকোওয়াস) নাইজারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং সমস্ত বাণিজ্যিক ও আর্থিক সম্পর্ক স্থগিত করেছে। এমকি নাইজারের সাথে এই ১৫টি দেশের লেনদেন এবং ইকোওয়াস এর কেন্দ্রীয় ও বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলোতে জমা নাইজারের সমস্ত সম্পদ জব্দ করা হয়েছে।
ইকোওয়াস-এর পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়, এক সপ্তাহের মধ্যে বাজুমের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে না দিলে নাইজারে সামরিক হস্তক্ষেপ করা হবে। এই সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই নাইজারের আকাশসীমা বন্ধ করে দেয় দেশটির অভ্যুত্থানপন্থি সামরিক নেতারা। নাইজারের সশস্ত্র বাহিনী দেশ রক্ষায় প্রস্তুত রয়েছে বলে ঘোষণা দেয় তারা। একই সাথে ইকোওয়াস সামরিক হস্তক্ষেপ করলে বাজোমকে হত্যা করার হুমকি দেয় তারা।
নাইজারের দুই প্রতিবেশী বুর্কিনা ফাসো এবং মালি নাইজারের অভ্যুত্থানকে সমর্থন করেছে এবং বলেছে, নাইজারে যে কোনো সামরিক আক্রমণ হলে সেটাকে তারা তাদের সবার ওপর আক্রমণ হিসেবে দেখবে। এই দুটি দেশে আগে থেকেই রাশিয়া-সমর্থিত সামরিক শাসন রয়েছে।
সুতরাং নাইজারে যে কোনো ধরনের সামরিক হস্তক্ষেপ একটি জটিল যুদ্ধের রূপ দিতে পারে। এমন একটি যুদ্ধের সূচনা করতে পারে যা হবে ঠিক ইউক্রেনের মতো। শুরু হতে পারে পশ্চিম এবং রাশিয়ার মধ্যে আরও একটি প্রক্সি যুদ্ধ।
অন্যদিকে এই মহাদেশে চীনের রয়েছে বিশাল অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ। তারাও ঘনিষ্ঠভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং নিজস্ব পদক্ষেপের পরিকল্পনায় তারা কাজ করবে এটা পরিষ্কার।
দ্য নিউ গ্রেট গেম
আফ্রিকা হল সেই থিয়েটার যেখানে গ্রেট গেমের ২১ শতকের সংস্করণ মঞ্চায়িত হচ্ছে। নাইজারের অভ্যুত্থান এই মঞ্চকে প্রকাশ্যে এনেছে। এই গেমের খেলোয়াড়রা হলো পশ্চিম, রাশিয়া ও চীন। পরাশক্তিদের এই খেলায় ঝুঁকিতে রয়েছে মহাদেশের কৃষি এবং বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ।
বিশ্বের মোট আবাদযোগ্য জমির ৬৫ শতাংশই আফিকা মহাদেশের দখলে। বিশ্বের খনিজ সম্পদের প্রায় ৩০ শতাংশ, প্রাকৃতিক গ্যাসের ৮ শতাংশ এবং তেলের মজুদের ১২ শতাংশ রয়েছে আফ্রিকায়। এই মহাদেশে বিশ্বের ৪০ শতাংশ সোনা এবং ৯০ শতাংশ পর্যন্ত ক্রোমিয়াম এবং প্ল্যাটিনাম রয়েছে।
বিশ্বের মোট কোবাল্ট, হিরা, প্ল্যাটিনাম এবং ইউরেনিয়ামের সবচেয়ে বড় মজুদ আফ্রিকায়। এই সমস্ত কিছুর সাথে এর ভৌগোলিক অবস্থান একে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক খেলার মঞ্চে পরিণত করেছে। যেখানে রয়েছে পরাশক্তিদের ক্ষমতা এবং শক্তির প্রতিযোগিতা।
তবুও আফ্রিকা এই গ্রহের সবচেয়ে দরিদ্রতম মহাদেশ এবং আজও পশ্চিম দ্বারা সবচেয়ে নির্মমভাবে শোষিত মহাদেশ। উদাহরণস্বরূপ, নাইজার বিশ্বের অন্যতম ইউরেনিয়াম রপ্তানিকারক দেশ হয়েও জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে ১৯১টি দেশের মধ্যে এর অবস্থান ১৮৯তম।
আফ্রিকায় ফ্রান্সের স্বার্থ
আফ্রিকা মহাদেশের দুর্দশার পেছনে অন্যতম কারণ পশ্চিমা ঔপনিবেশিকতাবাদ। ফ্রান্সের মতো পশ্চিমা ঔপনিবেশিকরা এখনও আফ্রিকা ছেড়ে যায়নি। ১৯৬০ সালে ফ্রান্স তার বেশিরভাগ আফ্রিকান উপনিবেশকে স্বাধীনতা দেয়—যেমন নাইজার, নাইজেরিয়া, মালি, বুরকিনা ফাসো, সেনেগাল এবং আইভরি কোস্ট। কিন্তু এখনও তাদের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকায় কখনোই যার উপনিবেশ ছিল না, কিন্তু মহাদেশে গত ৫০ বছর ধরে অত্যন্ত সক্রিয় ছিল।
ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্ব উপনিবেশিক আমল থেকে আফ্রিকাকে শোষণ করে চলেছে। আফ্রিকার খনিজ সম্পদগুলোর নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে। তারা এসব খনি থেকে সম্পদ উত্তোলন এবং ভোগ করছে যার বিনিময়ে খুব সামান্যই সুবিধা পায় আফ্রিকার দেশগুলো।
ফ্রান্স প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য আফ্রিকার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। ফ্রান্সের বিদ্যুৎকেন্দ্রের চার ভাগের তিন ভাগ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এসব কেন্দ্রের কাঁচামাল ইউরোনিয়ামের বড় জোগানদাতা গ্যাবন, মালি, নাইজারসহ আফ্রিকার অন্যান্য দেশেগুলো। দেশটির কাছ থেকে আফ্রিকার দেশগুলো ৬০ বছর আগে স্বাধীনতা পেলেও এখনো এ দেশগুলোতে সত্যিকার স্বাধীনতা নেই। এমনকি স্কুলের পাঠ্যসূচি পর্যন্ত এখনো ফ্রান্স ঠিক করে দেয়।
ফ্রান্স আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদ ইউরোনিয়াম, স্বর্ণ, জ্বালানি, কফির ওপর একচেটিয়া দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে। ফ্রাংক ব্যবহারকারী ১৪টি দেশের জলবিদ্যুৎ, টেলিফোন, পরিবহন, ব্যাংক, কৃষি, নির্মাণশিল্প- সবই ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্রান্সই একমাত্র দেশ যে তার সাবেক উপনিবেশগুলোতে এখনো শোষণের ধারা অব্যাহত রেখেছে। বলা যায়, ফ্রান্সের টিকে থাকা অনেকাংশে নির্ভর করে তার সাবেক উপনিবেশ আফ্রিকাকে শোষণের মধ্য দিয়ে।
নাইজার, সুদান, বুরকিনা ফাসো এবং মালিসহ পশ্চিম আফ্যিকার দেশগুলোতে একেরপর এক সামরিক অভ্যুত্থান এবং ক্রমবর্ধমান পশ্চিমাবিরোধী মনোভাবে এসব দেশগুলো ফ্রান্সের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। ফলে মহাদেশের এই গ্রেট গেম-এ নিজের অবস্থান ধরে রাখতে মরিয়া ফ্রান্স। (২য় পর্বে সমাপ্ত)
সন্দীপন দেব: ভারতীয় সাংবাদিক ও লেখক
ফার্স্টপোস্ট থেকে ভাষান্তর - মুজাহিদুল ইসলাম
মন্তব্য করুন